চলে আমার সাইকেল হাওয়ার বেগে উইড়া উইড়া এর মধ্যেই দেখি আমার নাবালিকা লাপাত্তা। গেলো কই গেলো কই? খুঁজতে খুঁজতে দেখি নাজমুল আলবাব মিয়ার সুপুত্র তারে মটর সাইকেলের পিছনে বসায়ে ''চলে আমার সাইকেল হাওয়ার বেগে উইড়া উইড়া'' গাইতেছে। কোনোরকমে তারে উদ্ধার কইরাই ভাবলাম এই বাড়িতে আর থাকা যাবে না। পলাই। যত্তারাতারি সম্ভব গাট্টি বুচকা নিয়া রওনা দিলাম। অচেনা শহরে কার উপরে আর ভরসা করবো? নাজমুল আলবাব তার সপরিবারে আমাদের সঙ্গে ঘুরতে বের হইলো। সে নিজেই গাড়ি চালায়। আমি তো ভয়ে অস্থির। আগেই শুনছি সে খুবই কাঁচা ড্রাইভার। কুলফু আল্লাহু তো ভুলছি সেই ছোটবেলায়। তাই জানের ছদকা দিতে আর দোয়া নিতে পয়লাই গেলাম হজরত শাহ্ জালাল (রঃ) এর মাজারে। কবুতরের সঙ্গে ফটোসেশন হলো কিছুক্ষন। সংস্কারকাজ চলছে বিধায় অনেক জায়গাতেই এখন যাওয়া যাচ্ছে না। তাই তাড়াতাড়িই সেখান থেকে বের হওয়া গেলো। ইতোমধ্যে মুস্তাফিজ ভাইয়ের কাজ শেষ। একসঙ্গে জাফলং যাওয়ার কথা। তিনি অপেক্ষা করছেন। কিন্তু নূপুরের এক আত্মীয় থাকেন কাছেই। তার বাড়িতে একটু ঢুঁ মারতেই হবে। তাই সেখানে যেতেই হলো। এবং খুবই অভদ্রভাবে সেখান থেকে প্রায় কিছু না খেয়ে বিদায় নিলাম। তারপর নানান গলি ঘুপচি পেরিয়ে আমরা যেতে লাগলাম জাফলঙের দিকে। হালকা বৃষ্টি হচ্ছে তখন। এর মধ্যে এগিয়ে চলা। অপু একে একে দেখাচ্ছিলো... এই যে এমসি কলেজ... এখানেই পড়েছে অনেক সচল... এই যে স্কুল। দেখাচ্ছিলো তাদের প্রেমের জায়গা। ঘৃণার জায়গা। সেনানিবাস পেরিয়ে আবার স্কুল কলেজ পেরিয়ে, ঐ দূরে লিলেন্দার বাড়ি... সব দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিলো সিলেটটা আসলেই যেন খুব কাছের। নদীটা খুবই পছন্দ হইলো দুটো গাড়ি ছুটে চলেছে জাফলং-এর দিকে। মুস্তাফিজ ভাই আগের গাড়ি থেকে ফোন করলো। চলেন চা খাই। এটাই যেন মনে মনে চাচ্ছিলাম। নেমে গেলাম সারি নদীর পাড়ে। অদ্ভুতরকম দারুণ স্বাদের লেবু চা খেলাম। শান্ত নদীটা ভালো লাগলো। সেখানে চললো ফটোসেশন। মুস্তাফিজ ভাই ক্যামেরার সঙ্গে ম্যাচ করে পোশাক পরেন আসলে এই ট্যুরে আমার ছবি দেওয়া উচিত না একেবারেই। কারণ মুস্তাফিজ ভাই এবং ফখরুল ভাই ছিলেন সাথে। মুস্তাফিজ ভাইকে তো এখানকার সবতেই চেনেন, ফখরুল ভাই হলেন আরেক বস ফটুরে। উনারা দুজন যেখানে ছবি তোলেন সেখানে আমার তাকায়া থাকা ছাড়া আদতেই কিছু করার থাকে না। আশা করছি মুস্তাফিজ ভাই একটা ছবি ব্লগ দিবেন। অনেক ফাটাফাটি সব ছবি তুলছেন। অদ্ভুত সুন্দর একটা জায়গা তো তারপর আবার পথচলা। এবার আমার গাড়িন্নোতি হলো। আমি আলবাবের গাড়ি ছেড়ে মুস্তাফিজ ভাইয়ের গাড়িতে চড়ে বসলাম। কেক কুক খেতে খেতে গাড়ি চললো। দুই দুইজন বস ফটোগ্রাফার থাকলে যা হয়, ছবি তোলার জন্য জোশ ভিউটার খোঁজ চলছে। এরই মধ্যে হঠাৎ একটা জায়গায় ঘ্যাঁচ করে গাড়ি থামিয়ে দিলো মুস্তাফিজ ভাই। তারপর দুজনেই নেমে পাগলের মতো ছবি তুলতে লাগলো। আমি তাকায়া দেখলাম এক অপরূপ দৃশ্য। মেঘ আর পাহাড়ের লুকোচুরি, তার নিচে লেক (নাকি নদী?), শান্ত পানিতে পাহাড়ের ছায়া, আর সেখানে একটা ছোট্ট নৌকা ভাসছে... দৃশ্যটা যে কতো সুন্দর তা সত্যিই বোঝাতে পারবো না। এমনকি আমার তোলা দূর্বল ছবি দিয়াও না। মুস্তাফিজ ভাই এখানে ফাটাফাটি কিছু ছবি তুলছেন। সেগুলা দেইখা নিয়েন। আহ্ তারপর আবার পথচলা। জাফলং যে এতো দূরে জানা ছিলো না আমার। কিন্তু মুস্তাফিজ ভাইরা আবারো গাড়ি থামালেন। জাফলং পড়ে, আগে শ্রীপুর যাওয়া যাক। রাস্তা ভালো না। চা বাগানের পাশে গাড়ি রেখে বাকিটুকু হেঁটে যেতে হবে। মুস্তাফিজ ভাই আর ফখরুল ভাই ক্যামেরাকামান নিয়ে ছুটলেন। আমি ভাবলাম শ্রীপুর আর এমন কী? তারা তুলুগ্গা ছবি, আমি মেয়েরে খিচুড়ি খাওয়ায়া আস্তে ধীরে নামলাম। এইটা দেখে আসলে জায়গাটা বোঝা যাবে না, মুস্তাফিজ ভাইয়ের ছবির জন্য অপেক্ষা করেন আর নেমেই তাব্দা খায়া গেলাম। অদ্ভূত সুন্দর একটা জায়গা। এইটারও বর্ণনা দেওয়া সম্ভব না। আমি ছবি তোলার কোনো চেষ্টাই করলাম না। হা করে তাকায়ে থাকলাম কিছুক্ষন। বিকেলের আলোয় মেঘ আর পাহাড় মিলে মিশে একাকার। তার নিচে নদী। শান্ত, নিরিবিলি। এক বৃদ্ধা বড়শী নিয়ে বসেছে মাছ ধরতে। আহ্... এখানেও বলে রাখি। বর্ণনার সঙ্গে মিলিয়ে নেবেন মুস্তাফিজ ভাইয়ের ছবি। তখন বুঝবেন আমি যে মিছা কথা কই নাই... নূপুর আর নিধি দারুণ আনন্দ পাইছে ততোক্ষনে আমি সিলেটের ব্যাপারে পুরাই মুগ্ধ। গাড়ি আবার ছুটলো জাফলঙের দিকে। কিন্তু এইবার পুরাই হতাশ হইলাম। জাফলং-এ খুবই হতাশ তবে ততক্ষনে নিধি তমাল কাহিনী বেশ ভালোই জমছে মনে হয় জাফলঙ দেখে প্রাণ জুড়াইলো না। বুঝলাম শীতে আসতে হবে। বেসিজনে চলে আসছি। তবু নৌকায় চড়ে ওপাশে যেতে পারলে হয়তো একটা ব্যাপার হতো। কিন্তু সময়াভাবে যাওয়া হলো না। কিছুক্ষন হুদাই ঘুরঘুর করে ফিরতে লাগলাম আবার শহরের পথে। সন্ধ্যা হয় হয়। মুস্তাফিজ ভাইরা আগেই চলে গেলো। আমরা আস্তে ধীরে চলতে লাগলাম। পথে এক জায়গায় থেমে দূরের পাহাড় দেখলাম আরো কিছুক্ষণ। ইশ্, এই পাহাড়গুলো আমাদের না কেন? এপাড়ে বসে ওপাড়ের ঝর্ণার ধ্বনি শুনি তারপর আবার এগিয়ে চলা। ততক্ষনে ক্ষুধা লেগে গেছে। নাজমুল আলবাব নিয়ে গেলো দারুণ এক হোটেলে। একেবারে ছাপড়া হোটেল। পথের পাশেই। সেখানে হাত ধোয়ার বন্দোবস্ত সবচে দারুণ। একটা বড় ড্রামে পানি আর মগ। আর দুইটা গাছে দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে টুথ পাউডার, টুথপেস্ট, সাবান, মাজন... আরো কী কী যেন, মোট আটটা পদ। পথের ধারে হোটেল বিসমিল্লাহ্ খেতে বসে আরেক চমক। হাঁস আর কুড়া। আহ্... আমি সবসময় মনে করি একটা অঞ্চলকে চিনতে হলে, জানতে হলে, কালচার বুঝতে হলে, সবার আগে সে অঞ্চলের খাবার খেতে হবে। কুড়া হলো সিলেট সুনামগঞ্জের ঐতিহ্য। সেই ছোটবেলা থেকে মৈমনসিংহ গীতিকায় (এটা তো আসলে সুনামগঞ্জ সিলেট অঞ্চলের গীতিকা) কুড়া শিকারের কথা পড়েছি। কখনো খাইনি। অতএব চললো হাঁস আর কুড়া সহযোগে ভাত। ঝাল ঝাল কুড়া খেয়ে আমি মহামুগ্ধ। এরচেয়ে পরিতৃপ্ত সফর আর হতে পারে না। ভাত টাত খেয়ে আবার শহরে ফেরা। ফিরতে ফিরতেই মৌলভীবাজারে যাওয়ার বন্দোবস্ত করে নিলাম। সচল বন্ধু সুমন সুপান্থর ভাই অপূর্ব সোহাগ সেখানে একটা হোটেল ঠিক করে দিলো। আমরা সিলেটকে, সিলেটের মানুষকে, নাজমুল আলবাব পরিবারকে বিদায় আর ধন্যবাদ জানিয়ে গাড়ি নিয়ে ছুটে চললাম মৌলভীবাজারের পথে। অনেক দারুণ একটা ভ্রমণের শেষেও আফসোস থেকে গেলো আরো কতো কিছুর। ইচ্ছে থাকলেও সিলেট শহরটা ঘুরে দেখা হলো না। দেখার ইচ্ছে ছিলো শ্রী চৈতন্যদেবের মন্দির, জৈন্তার রাজবাড়ি... আরো কতো কিছু। এবার শুরু হবে মৌলভীবাজার শ্রীমঙ্গল জয়... তার আগে একটু চা খেয়ে আসি