নির্বাসন-বিরহ-আষাঢ়ের মেঘ: রবীন্দ্রনাথ, বোদলেয়ার, বিদ্যাপতি এবং কালিদাস 26 Jun , 2021 রবীন্দ্রনাথ, বোদলেয়ার, বিদ্যাপতি এবং কালিদাসের মতো সাহিত্যের জ্যোতিষ্কপুঞ্জকে আলোচনা অথবা সমালোচনা করার ধৃষ্টতা আমার নেই। নিদারুণ শঙ্কিত চিত্তে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি গীতিময়ী কবিতার স্তুতিবাক্য উচ্চারণ করবো। সাথে সাথে আষাঢ়ের মেঘবিজুরিত নিসর্গের আভরণে আমার নির্বাসন দগ্ধ অন্তরের বিহার ঘটবে বিদ্যাপতি এবং কালিদাসের বর্ষণসিক্ত ভুবনে। সঙ্গীতের অন্তরায়ের মত বোদলেয়ার আমাকে দোলা দেবে ইট-কাঠ-লোহার শৃঙ্খলে বদ্ধ শহরের রিক্ততায়। কবিগুরুর ‘নবগীতিকা’র গীতিময়ী কবিতার প্রারম্ভে রয়েছে “বহু যুগের ওপার হতে আষাঢ় এল আমার মনে কোন সে কবির ছন্দ বাজে ঝরো ঝরো বরিষণে” লিরিকধর্মী ছোট এই কবিতায় বর্ষাকালের বাদল বরিষণের অপূর্ব চিত্রকল্প এঁকেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাংলার নিরুপমা প্রকৃতির অবগুণ্ঠনে রয়েছে প্রেমের অভিসার, বিরহের নিঃসঙ্গ আকুতি অথবা অদৃশ্য অসীমের দৃশ্যমান পদার্থের নিপিষ্ঠতা। আষাঢ়ের অবিরাম বর্ষণ কবির মনকে মেঘের পাখায় করে সময়ের বিপরীতে প্রায় দেড় হাজার বছরের অধিক অতীতের ভারতবর্ষে নিয়ে গেছে। মহাকবি কালিদাসের সেই ভারতবর্ষে বিরাজিত ছিল অবন্তী, উজ্জয়িনি, বিদিশা, অলকা আর বিদর্ভ নগরী। সেই ভারতবর্ষে প্রবাহিত হত বেত্রাবতি, শিপ্রা, রেবা, নির্বন্ধ্যা ইত্যাদি নিরুপমা স্রোতস্বিনী। কালিদাসের মেঘদূতের বিরহী যক্ষ রামগিরি পাহাড়ের নির্বাসনে বর্ষার সিক্ত মেঘে কুড়িয়ে পায় মিলনের বিধ্বস্ত পুষ্পের স্তিমিত গন্ধ। কবিগুরুর কোমল কল্পনায় – তাঁর নন্দিত ভাষায় আমরা শুনতে পাই: “যে মিলনের মালাগুলি ধূলায় মিশে হল ধূলি গন্ধ তারি ভেসে আসে আজি সজল সমীরণে।” কালিদাসে মেঘদূতের প্রতি কবিগুরুর মৃদু ইঙ্গিত আমার হৃদয়ে এনেছে বেদনার, বিরহের, হারানোর পুঞ্জিভূত মেঘ। মেঘদূতের যক্ষের মত আমি “শ্বাপেন্যস্তংগমিতামহিমা” কিনা জানি না। পুঁজিবাদী দেবতার শাপে অথবা অভিশাপে আমার যৎসামান্য মহিমাগুলো গত হয়েছে কি না জানি না। তবে এটুকই নিশ্চিত: আমি এখানে রয়েছি স্বেচ্ছা নির্বাসনে। মনে হয় আজন্ম নিরুদ্দিষ্ট। জন্মভূমি ছেড়ে প্রায় নয় হাজার মাইল দূরে প্রার্থিত এই নির্বাসনে আমার ক্লান্ত মনে বেজে উঠে বেদনার রিনিঝিনি। দেড় হাজার বছর আগেকার নির্বাসিত যক্ষের হৃদয়ের এক ব্যথিত চিত্রকল্প নীরবে আমাকে পীড়া দেয়। আমি অনুভব করি আরও হাজার বছর আগের ঐ রামগিরি পাহাড়ের নিভৃত অরণ্যে মহাকবি বাল্মীকির চিরায়ত নির্বাসিতা সীতার হৃদয়ের এক অদ্ভুত তরঙ্গ – বেদনার, বিস্ময়ের, নির্জনতার। কক্ষচ্যুত নক্ষত্রের মতো অযুত বছর ধরে স্থানকালের সীমানা ছাড়িয়ে জীবিকার তীর্থযাত্রী নির্বাসিত সহস্র মানুষ-মানুষীর প্রবল প্লাবন। সভ্যতার আঁশটে-পৃষ্ঠে শৃঙ্খলিত মানব মানবী। দারুণ নিঃসঙ্গ। জীবিকার গৌণ পৃথিবীতে বন্দি। যেন আন্দামান দীপপুঞ্জের কালাপাহাড়ে নিজন নির্বাসনে তারা উন্মুখ হয়ে আছে। মিলনের। মুক্তির। আমি নিজেই যেন বন্দী হয়ে আছি এক অচিন শহরে – ইট, কাঠ পোড়ামাটি আর শ্বাসরুদ্ধকর বিষাক্ত অবগুণ্ঠনে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গানের আদলে আমি অবরুদ্ধ ইটের পাঁজরে আর লোহার খাঁচার প্রাণহীন এই শহরে। মনে হয় এই ভিন নগরীর কোন নিভৃত অন্ধকার কক্ষ থেকে আমি শুনছি নিষ্পেষিত নিঃশ্বাসের শব্দ। বোদলেয়ারের ভাষার অনুকরণে চিৎকার করে বলতে চাই: New Orleans may change; my Melancholy is fixed. হয়তো বোদলেয়ারের এনড্রোম্যাকি (Andromache) তাকিয়ে আছে, অশ্রুর ঢলে সিমোয়া নদিতে প্লাবন নেমেছে; হেক্টর (Hector) আর কোনোদিন আসবে না, কোনদিন আসবে না জেনে। তার চোখেও বাল্মীকির সীতার মতো চিরায়ত নির্বাসিতের করুন চাহনি – অশ্রুসিক্ত, ভেজা ভেজা। কবিগুরুর লিরিকধর্মী এই কবিতায় প্রকাশিত: কালিদাস তার নির্বাসিত যক্ষ আষাঢ়ের মেঘকে দূত করে পাঠিয়েছে প্রেয়সী কান্তার কাছে সুদূর কৈলাস গিরিশৃঙ্গের অলকা নগরীতে। পৃথিবীর অন্য প্রান্তে, বোদলেয়ারের ‘লা সিনিয়াতে’ রাজহংস মেঘহীন নীলাকাশের জন্য অভিশাপ দিচ্ছে বিধাতাকে। “Sometimes yet Like him that Ovid writes of, lifting up Unto the cruelly blue, ironic heavens, With stretched, convulsive neck a thirsty face, As though he sent reproaches to God” মেঘসিঞ্চিত যক্ষ এবং মেঘবর্জিত রাজহংস উভয়েই নির্বাসিত, অন্তরীণ। আমার নিজের এই ভিন নগরীর বনবাসে অন্তরীণ মুহূর্তগুলোতে কালিদাসের মেঘ, আর বোদলেয়ারের বৃষ্টিহীন নীলাকাশকে আমার প্রতিকারহীন আকুতিগুলো আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি। যুগ যুগান্ত ধরে বাদল, মেঘ আর অবিরাম বর্ষণের সাথে বাঙালির হৃদয়ের বন্ধন। বাংলা কাব্যের বিবর্তনের আদি লগ্নে মিথিলার কবি বিদ্যাপতির কবিতায় বিরহ, মিলনের আকুতি ও বর্ষায় প্রেমসিক্ত সৌন্দর্যের মনোরম প্রকাশ আমরা দেখতে পাই। বর্ষনক্লান্ত দিবসে বিরহ কুঞ্চিত রাধার পরম আকুতি বিদ্যাপতির ভাষায় “এ ভরা বাদর, মাহ ভাদর শূন্য মন্দির মোর ঝঞ্ঝাঘন গরজন্তি শন্ততি ভুবন ভরি বারিখন্তিয়া কন্ত পাহুন, বিরহ দারুণ – সঘন খরশর হন্তিয়া” কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায় রেবানদীর তীরে অথবা কৈলাস গিরিশৃঙ্গে পুঞ্জিভূত মেঘে রয়েছে এক পরম আকুতি, করুন চাহনি – ঘনকাল মেঘের ছায়ায় সে করুণ চাহনির বর্ষণ নিসর্গকে সিক্ত করে। কবিগুরুর ভাষায় “সে দিন এমনি মেঘের ঘটা রেবা নদীর তীরে এমনি বারি ঝরেছিল শ্যামল শৈলশিরে। মালবিকা অনিমেখে চেয়ে ছিল পথের দিকে সেই চাহনি এল ভেসে কালো মেঘের ছায়ার সনে।” শুধু মানব মানবীর প্রেমই নয়। আমাদের হৃদয়ের অতলান্তে এক অবিরাম বাসনার অন্তহীন উৎস রয়েছে। কোনো এক মহা উৎসের খোঁজে অন্তর যেন ক্ষণে ক্ষণে স্পন্দিত হয়। ভাষার চিত্রকল্পে সেই অমোঘ আকুতির খানিকটা বহিঃপ্রকাশ ঘটে। হৃদয়ের তৃপ্তিহীন আকুতির অনাবিল আকাঙ্ক্ষা যেন মরীচিকার মতো আমাদের প্রতারণা করে। চিরায়ত শূন্য মন্দির বুকে নিয়ে আমরা ঘুরে বেড়াই – যেন নর নারায়ণ – এক আজন্ম ভিখারি। শেয়ার করুন