Anandabazar
আজ নয় কাল প্রশ্ন উঠবেই
কংগ্রেসের মতো বিজেপিতেও এখন ‘হাইকমান্ড’ সংস্কৃতি
প্রেমাংশু চৌধুরী
০৮ জুলাই ২০২১ ০৪:৫৬
অগস্ট ১৯৮৪। উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা ভোটের আর এক বছর বাকি। ঠিক এখনকার মতোই। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী আচমকাই উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে শ্রীপতি মিশ্রকে সরিয়ে দিলেন। নারায়ণ দত্ত তিওয়ারি তখন ভিয়েনায়। তাঁকে তলব করা হল। লখনউয়ের গদিতে বসতে হবে।
উত্তরপ্রদেশের ইতিহাস বলে, ১৯৮০ থেকে ১৯৮৫— এই পাঁচ বছরে কংগ্রেসের পাঁচ জন মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। রাজ্যের বিধায়করা কাকে চাইছেন, চুলোয় যাক! ইন্দিরাই ঠিক করতেন যে, কে কখন মুখ্যমন্ত্রী হবেন। মহারাষ্ট্র থেকে মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান থেকে বিহার— ইন্দিরার এক ইশারায় মুখ্যমন্ত্রী বদলে যেত।
নরেন্দ্র মোদী জমানায় উত্তরাখণ্ডে গত চার বছরে বিজেপি সরকারের তৃতীয় মুখ্যমন্ত্রী শপথ নিলেন। প্রথমে ত্রিবেন্দ্র সিংহ রাওয়তকে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে সরাতে হয়েছিল। তীরথ সিংহ রাওয়তকে এনেও গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব মেটেনি। তাঁকে উপনির্বাচনে জিতিয়ে আনা নিয়েও জটিলতা ছিল। অতএব প্রবীণ নেতাদের আপত্তি অগ্রাহ্য করে তরুণ নেতা পুষ্কর সিংহ ধামি মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে। বলা বাহুল্য, বিজেপির বিধায়করা পুষ্করকে নির্বাচিত করেননি। তাঁকে বাছাই করেছেন নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহ। বিজেপির ‘হাইকমান্ড’।
Advertisement
Advertisement
নরেন্দ্র মোদী ‘কংগ্রেস-মুক্ত ভারত’-এর কথা বলেছিলেন বটে, কিন্তু তাঁর আমলে কংগ্রেসের ‘হাইকমান্ড সংস্কৃতি’ বিজেপিতে অনুপ্রবেশ করেছে। কংগ্রেসে এই হাইকমান্ড সংস্কৃতির আমদানি ইন্দিরার হাত ধরে। গত সাত বছরে নরেন্দ্র মোদীর রাজনৈতিক প্রতিপত্তি ও অমিত শাহের কড়া শাসনের সঙ্গে বিজেপিতেও সেই সংস্কৃতি ডালপালা মেলেছে।
কালের নিয়মে বিজেপি ও কংগ্রেস, দুই দলেই এখন রাজ্যে রাজ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব তুঙ্গে। বিধানসভা ভোটে হারের পর পশ্চিমবঙ্গ, কেরলে বিজেপির মধ্যে চাপানউতোর চলছে। ভোটমুখী উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড থেকে কর্নাটক, মধ্যপ্রদেশেও বিজেপিতে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব চলছে। অন্য দিকে, কংগ্রেস হাইকমান্ডও আধ ডজন রাজ্যে অন্তঃকলহ নিয়ে জেরবার। গাঁধী পরিবার রোজই ‘এ কুল রাখি, না ও কুল রাখি’ ভেবে কূল পাচ্ছে না।
ফারাক একটাই। ইন্দিরা-জমানার প্রবল শক্তিশালী কংগ্রেস হাইকমান্ড এখন সনিয়া গাঁধীর ইনিংসের শেষ পর্বে, রাহুল গাঁধীর জমানায় রক্তাল্পতায় ভুগছে। কিন্তু মোদী-শাহের হাইকমান্ডের হাতে এখনও বিজেপির লাগাম শক্ত করে ধরা। রাজ্যের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব সামলানো দূরে থাক, কংগ্রেস হাইকমান্ডের বিরুদ্ধেই বিক্ষুব্ধরা প্রকাশ্যে অসন্তোষ প্রকাশ করছেন। রাহুলের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে সনিয়াকে চিঠি লিখছেন। বিজেপির বিক্ষুব্ধরা এখনও মোদী-শাহের সামনে সে সাহস পাননি।
ইউপিএ সরকার যত দিন ক্ষমতায় ছিল, তখন সনিয়াকে কেন্দ্র করে কংগ্রেস হাইকমান্ডের প্রভাবও ছিল। ২০১৪-র পর তা অস্তমিত। ইন্দিরা কংগ্রেসকে ভোটে জেতানোর ক্ষমতা রাখতেন। সেই ক্যারিশমা রাহুলের অধরা। তাই কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী বা প্রদেশ কংগ্রেসের নেতাদের কাছেও হাইকমান্ডের কদর কমেছে। রাজস্থানে সচিন পাইলটকে জায়গা ছাড়তে বললেও মুখ্যমন্ত্রী অশোক গহলৌত তা কানে তোলেন না। পঞ্জাবে অমরেন্দ্র সিংহও গাঁধী পরিবারের কথায় নভজ্যোত সিংহ সিধুকে সূচ্যগ্র জমি ছাড়তে রাজি নন। অসম, কেরল, কর্নাটক, গুজরাতেও কংগ্রেসের অন্তঃকলহ বিদ্যমান।
বিজেপিতে ছবিটা এত দিন ভিন্ন ছিল। রাজ্যে রাজ্যে নরেন্দ্র মোদীকেই মুখ করে বিজেপি ভোটে গিয়েছে। অমিত শাহ থেকেছেন সেনাপতির ভূমিকায়। কে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী, কে-ই বা রাজ্য সভাপতি, তা গৌণ হয়ে ছিল। তাই মোদী-শাহের পছন্দমতোই মুখ্যমন্ত্রী নিয়োগ হয়েছে। ভোট জেতানোর ক্ষমতার জোরেই তাঁরা মহারাষ্ট্রে মরাঠার বদলে ব্রাহ্মণ দেবেন্দ্র ফডণবীস, জাঠ অধ্যুষিত হরিয়ানায় অ-জাঠ মনোহর লাল খট্টর, ঝাড়খণ্ডে আদিবাসী না হলেও রঘুবর দাসকে মুখ্যমন্ত্রী করার মতো সাহসী পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পেরেছেন। উত্তরাখণ্ডে চার বছরে তিন বার মুখ্যমন্ত্রী বদলানোও সেই হাইকমান্ড সংস্কৃতিরই পরিচয়। এ সব নিয়ে রাজ্য স্তরে বিজেপিতে ক্ষোভ তৈরি হলেও, মোদী-শাহের ভোটে জেতানোর ক্ষমতার জন্য কেউ টুঁ শব্দ করতে পারেননি।
এ বার ছবি বদলাচ্ছে। লোকসভা ভোটে দ্বিতীয় বার জিতলেও বিধানসভা ভোটে মোদী-শাহ জুটির ঝড়ে আর কাজ হচ্ছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছিল। হরিয়ানায় খট্টর ছাড়া দেবেন্দ্র-রঘুবররা কেউ জিতে ক্ষমতায় ফিরতে পারেননি। অসমে উচ্চাকাঙ্ক্ষী হিমন্তবিশ্ব শর্মা নিজের পাওনা বুঝে নিয়েছেন। উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথ, কর্নাটকে বি এস ইয়েদুরাপ্পার বিরুদ্ধে ক্ষোভ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। ত্রিপুরায় বিপ্লব দেবের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বার বার প্রকাশ্যে চলে আসছে।
তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হল, পশ্চিমবঙ্গে ভোটের পরে মোদী-শাহ জুটির ‘অপরাজেয়’ তকমা এখন ধূলিসাৎ। বাইরে থেকে অবাঙালি নেতাদের জড়ো করে কেন তাঁদের হাতে ভোট পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, তা নিয়ে কার্যত হাইকমান্ডের দিকেই প্রশ্নের তির। অমিত শাহ কার কথার ভিত্তিতে দু’শোর বেশি আসনে জেতার ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, তা এখনও অজানা। বিজেপির হাইকমান্ডের কংগ্রেসের মতো দুর্বল দশা হলে এত দিনে প্রশ্ন উঠত, ভোটে জিতলে তো সব কৃতিত্ব অমিত শাহই পেতেন। তা হলে বাংলার ভরাডুবির দায় তাঁর উপরে বর্তাবে না কেন!
হাইকমান্ড সংস্কৃতি জাঁকিয়ে বসলে দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র বিদায় নেয়। কংগ্রেসের হাল ফেরাতে বিক্ষুব্ধরা সাংগঠনিক নির্বাচনের দাবি তুলেছেন। যেন সভাপতি পদে নির্বাচন হলেই কংগ্রেসের সব রোগ নির্মূল হয়ে যাবে। ভাবের ঘরে চুরি একেই বলে! রাহুল সভাপতি পদে প্রার্থী হলে বিক্ষুব্ধদের কেউ কি তাঁর বিরুদ্ধে প্রার্থী হবেন? তা হলে নির্বাচনের সাজানো নাটকে কী লাভ! বিজেপি এখনও ভোটে জিতে চলেছে বলে দলীয় গণতন্ত্র নিয়ে কেউ মাথা ঘামাচ্ছেন না। বাস্তবে অমিত শাহ বা জগৎপ্রকাশ নড্ডারা কেউই সাংগঠনিক নির্বাচনে জিতে সভাপতি হননি। বিজেপি হাইকমান্ড তাঁদের সভাপতি পদে বেছে নিয়েছে। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সভাপতি পদের নির্বাচনে জেতাটা নিছক লোক দেখানো! অথচ, ২০১৪-র লোকসভা ভোটের আগে নরেন্দ্র মোদী সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থনের জোরেই প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে উঠে এসেছিলেন। লালকৃষ্ণ আডবাণী, যশবন্ত সিন্হাদের মতো হেভিওয়েট নেতাদের আপত্তি সত্ত্বেও।
এখন বিজেপির মধ্যেও হাইকমান্ড সংস্কৃতি ঢুকে পড়েছে শুনে কংগ্রেসের কোনও সমর্থক যদি ভাবেন, এক দিন বিজেপিরও কংগ্রেসের মতো দশা হবে, তা হলে বলতে হয়, বিষয়টা এত সহজ নয়। ইন্দিরা গাঁধী কংগ্রেস ভেঙে নিজের কংগ্রেস তৈরির পরে আর কোনও রাজ্যের নেতাকে শক্তিশালী হতে দেননি। কংগ্রেস তাঁকে মুখ করে রাজ্যের ভোটে যেত। তিনিই মুখ্যমন্ত্রী বাছাই করতেন। গাঁধী পরিবারের মতো রাজ্য স্তরেও পরিবারতন্ত্র জাঁকিয়ে বসে। রাজ্য নেতৃত্বে নতুন মুখ তুলে আনার রেওয়াজটাই চলে যায়। রাজীব গাঁধী কিছুটা হলেও ইন্দিরার ভুল বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি অন্ধ্রে ওয়াইএসআর রাজশেখর রেড্ডিকে তুলে এনেছিলেন। রাজীবের সেই রাজশেখর ২০০৪-এ অন্ধ্র থেকে কংগ্রেসকে বিপুল লোকসভা আসনে জিতিয়েছিলেন বলেই সনিয়া গাঁধী বাজপেয়ী-আডবাণীর বিজেপিকে হারাতে পেরেছিলেন।
বিজেপি কংগ্রেসের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছে। নিচু স্তর থেকে বিজেপি নেতাদের দলের নেতৃত্বে তুলে আনার রেওয়াজ অব্যাহত। কিন্তু মোদী-শাহ যুগে হাইকমান্ড সংস্কৃতির সঙ্গে বিজেপিতে নতুন অসুখ ঢুকেছে। কংগ্রেস বা অন্য দল থেকে নেতাদের ভাঙিয়ে আনা। তাতেও বিজেপির আদি নেতাদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে। উদাহরণ পশ্চিমবঙ্গ।
বিজেপি এখনও কেন্দ্রের সঙ্গে অনেক রাজ্যে ক্ষমতায়। তাই মোদী-শাহের পক্ষে দলের মধ্যে ক্ষোভ নিরসন করতে মন্ত্রিসভার সম্প্রসারণ, রাজ্যপাল পদে নিয়োগ বা অন্য কোনও সরকারি পদ পাইয়ে দেওয়া সহজ। কিন্তু ক্ষমতা চলে গেলে? তখনই হাইকমান্ড সংস্কৃতির আসল পরীক্ষা।
Advertisement