কক্সবাজারের পেকুয়ার রাজাখালীতে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ুয়া মাদরাসা শিক্ষার্থীকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ পরবর্তী অপমানে আত্মহননের ঘটনায় জড়িত বখাটেদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করতে থানায় লিখিত অভিযোগ দেন বাবা। কিন্তু সেই লিখিত অভিযোগ এজাহার হিসেবে না নিয়ে ফিরিয়ে দেওয়ার অভিযোগ করেছেন শিক্ষার্থীর বাবা।
শুধু তাই নয়, মেয়েকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের পর লজ্জায় বিষপানে আত্মহত্যা করেছে মর্মে তিনি (বাবা) যখন লিখিত অভিযোগ নিয়ে পেকুয়া থানায় যান, তখন থানার ওসি (পুলিশ পরিদর্শক-তদন্ত) সেই অভিযোগে মামলা হবে না বলেও সাফ জানিয়ে দেন। এমনকি ওই কর্মকর্তা থানার কম্পিউটার অপারেটরকে ডেকে নির্দেশনা দেন অপমৃত্যু মামলার অভিযোগ লিখে দিতে। এর পর অপমৃত্যুর ওই অভিযোগে তাকে (বাবা) স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেন পুলিশ কর্মকর্তা।
গত শনিবার (২৪ জুলাই) রাতে ওই শিক্ষার্থীর জানাজা শেষে লাশ দাফনের পর নিজ বাড়িতে স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছে পেয়ে এসব অভিযোগ আনেন বাবাসহ পরিবারের সদস্যরা। এ সময় বাবা, মা, ভাইসহ আত্মীয়-স্বজনেরা পুলিশের এই ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তারা পাশবিক এই ঘটনায় জড়িত তিন বখাটেকে দ্রুত গ্রেপ্তার এবং থানায় ধর্ষণের মামলা রুজু করতে পুলিশের ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
এদিকে গত শুক্রবার (২৩ জুলাই) রাজাখালী ইউনিয়নের হাজি পাড়ার বাড়ি থেকে ওই শিক্ষার্থীকে বাড়ির দরজা ভেঙে তিন বখাটে কর্তৃক জোরপূর্বক তুলে নিয়ে অদূরের একটি মৎস্যঘেরের টং ঘরে যখন সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করা হচ্ছিল, তখন চারিদিক থেকে স্থানীয় লোকজন জড়ো হয়। এ সময় স্থানীয় লোকজন ধর্ষক বখাটেদের পাকড়াও করলেও পরবর্তীতে ছেড়ে দেয়। একই সময়ে ধর্ষিতা শিক্ষার্থীকে উদ্দেশ্য করে নানা কটূক্তিও করে স্থানীয়রা। একদিকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, এই ঘটনা নিয়ে স্থানীয় লোকজনের কটূক্তির কারণে ভীষণ লজ্জা-অপমানবোধ করে ওই শিক্ষার্থী। এসব কারণে ওই শিক্ষার্থী ঘটনার পরদিন কীটনাশক (বিষ) পানে আত্মহননের পথ বেঁছে নেয়। এসব তথ্যও তুলে ধরেছেন কিশোরীর পরিবার সদস্যরা।
শিক্ষার্থীর বাবা বলেন, ‘ধর্ষণ ও পরবর্তী কীটনাশক পানের যে ঘটনা ঘটে, তখন আমরা (স্বামী-স্ত্রী) বাড়িতে ছিলাম না। পাশের বাঁশখালী উপজেলায় আত্মীয়ের বাড়িতে ছিলাম। শনিবার ভোররাতে ছেলে ফোন করে এসব বিষয় জানালে আমি ও স্ত্রী বাড়িতে ছুটে আসি। এরপর মেয়েকে উদ্ধার করে পেকুয়া উপজেলা হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করলে ফের মেয়েকে বাড়িতে নিয়ে আসি।’
তিনি জানান, স্থানীয়দের কাছ থেকে তিনি জানতে পারেন, স্থানীয় মৃত বাদশার ছেলে আলমগীর, নুরুল হকের ছেলে রবি আলম ও চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার ছনুয়া এলাকার মকসুদ আহমদের ছেলে আবুল কাশেম তাঁর মেয়েকে জোর করে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করেছে। সেই অপমান সইতে না পেরে সে কীটনাশক পান করে আত্মহত্যা করে। বিষয় দুটি পুলিশকে জানানো হলেও তারা ধর্ষণের অভিযোগ আমলেও নেয়নি। শুধু বিষপানে আত্মহত্যা করেছে মর্মে অপমৃত্যু মামলা রুজু করেছে। এই অবস্থায় বখাটে ধর্ষকরা এলাকায় বীরদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অভিযুক্ত বখাটেদের বয়স ১৮ থেকে ২০ বছরের মধ্যে। সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার তাঁর মেয়ের বয়স ১৪ বছর। সে রাজাখালী বহুমুখী বেশারাতুল উলুম ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থী।
কান্নায় ভেঙে পড়ে দিনমজুর বাবা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমার মেয়ে কী কারণে বিষপান করলো, পুলিশ সেটি আমলে নেওয়ার কোন ধার ধারেননি। এই অবস্থায় সপরিবারে চরম নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছি আমরা। কারণ ইতোমধ্যে আমার অভিযোগের প্রেক্ষিতে পত্র-পত্রিকায় বখাটে-ধর্ষকদের নাম প্রকাশ হয়েছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে মামলা বা তারা গ্রেপ্তার না হওয়ায় আতঙ্কে রয়েছি।’
একমাত্র মেয়েকে হারিয়ে বার বার ডুঁকরে ডুঁকরে কেঁদে উঠছিলেন গর্ভধারিনী মা। তিনি কান্না করতে করতে বলেন, ‘আবুল কাশেম, আলমগীর, রবি আলম এই তিনজন মিলে আমার মেয়েকে ধরে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করেছে। আমি তাদের কঠিন শাস্তি এবং ফাঁসি চাই।’
গতকাল রবিবার বিকেলে যোগাযোগ করা হয় বিষপানের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যাওয়া এবং ওই শিক্ষার্থীর সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরিকারী পেকুয়া থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) নাজমুল হোসেনের সাথে। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘থানার ঊর্ধতন কর্মকর্তার নির্দেশে আমি শিক্ষার্থীর বাড়িতে গিয়ে লাশটি উদ্ধার করি এবং সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে নিয়মানুযায়ী ময়নাতদন্তের জন্য লাশ কক্সবাজার সদর হাসপাতাল মর্গে প্রেরণ করি। এর পর রাতেই লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হলে জানাজা শেষে লাশ দাফন করা হয়।’
পেকুয়া থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) কানন সরকার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ওই শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ করা হয়েছে মর্মে থানায় কোন লিখিত অভিযোগ পরিবারের পক্ষ থেকে করা হয়নি। বিষপানে আত্মহত্যা করেছে খবর পেয়ে পুলিশ বাড়িতে গিয়ে সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি শেষে ময়নাতদন্তের জন্য লাশ মর্গে প্রেরণ করে।’
পরিবারের অভিযোগের বিষয়ে পেকুয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সাইফুর রহমান মজুমদারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ঈদের ছুটি কাটিয়ে বাড়ি থেকে কর্মস্থলে এসে আমি কোয়ারেন্টিনে রয়েছি। তাই শিক্ষার্থীর বাবা বা কারোর সাথে আমার সরাসরি দেখা বা কথাও হয়নি। তবে ওই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর কারণ হিসেবে হাসপাতালের রেকর্ডে উল্লেখ রয়েছে কীটনাশক পান বা পয়জনিং এসল্ট। সেই অনুযায়ী পুলিশ ওই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় অপমৃত্যু মামলা রুজু করেছে।’
ওসি সাইফুর রহমান মজুমদার আরো বলেন, ‘অপমৃত্যু মামলা নেওয়া হলেও পরবর্তীতে সেই মামলাটি ধর্ষণের মামলায় রূপান্তরেরও সুযোগ রয়েছে। যদি ময়নাতদন্তের রিপোর্টে ধর্ষণের আলামত উঠে আসে। এজন্য পরিবারকে অপেক্ষা করতে হবে।’
এই রকম আরো খবর