রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আরাফার দিনের রোজার ব্যাপারে আমি আল্লাহর কাছে আশাবাদী যে তা বিগত এক বছর ও আগত এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করিয়ে দেবে।’ (মুসলিম, হাদিস : ১১৬২)
আরাফার দিনের বিশেষত্ব : উক্ত হাদিসে ‘আরাফার দিন’ বলতে ৯ জিলহজের কথা বলা হয়েছে। ৯ জিলহজ ‘আরাফার দিন’ বলার তিন কারণ বিজ্ঞ আলেমরা উল্লেখ করেছেন।
এক. ইবরাহিম (আ.) ৮ জিলহজ রাতে স্বপ্ন দেখেন যে তিনি তাঁর একমাত্র পুত্রসন্তানকে জবাই করছেন। কিন্তু স্বপ্নটির মর্ম সুস্পষ্টভাবে বুঝতে পারেননি, তাই চিন্তিত ছিলেন। তারপর ৯ জিলহজ পুনরায় ওই স্বপ্ন দেখার পর তার ব্যাখ্যা সুস্পষ্টরূপে বুঝতে ও চিনতে সক্ষম হন। ঘটনাটির স্মরণে ৯ জিলহজকে ‘আরাফার দিন’ বলা হয়। কেননা ‘আরাফা’ শব্দের অর্থ হলো জানা, চেনা ইত্যাদি। (তাফসিরে বাগাবি ৭/৪৮)
দুই. জিবরাঈল (আ.) ৯ জিলহজে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে হজের আমলগুলো বিস্তারিত জানিয়েছেন। আর ‘আরাফা’ শব্দের এক অর্থ হলো জানা। তাই ৯ জিলহজকে ‘আরাফার দিন’ বলে। (আল-বিনায়া ৪/২১১)
তিন. এই দিনে হজযাত্রীরা হজের আমল হিসেবে ‘আরাফা’ প্রান্তরে অবস্থান করেন। তাই ৯ জিলহজকে ‘আরাফার দিন’ বলা হয়। (আল-ইনসাফ ৩/২৪৪)
এ আলোচনায় স্পষ্ট হলো যে আরাফার দিনের নামকরণের একমাত্র কারণ ‘আরাফা’ প্রান্তরে অবস্থান নয়, বরং অন্য কারণও রয়েছে। তাই এই দিনকে সব দেশের ক্ষেত্রে আরাফায় অবস্থানের সঙ্গে নির্ধারিত করা ঠিক নয়, বরং ৯ জিলহজ হলো ‘আরাফার দিন’। এখন যে দেশে যেদিন জিলহজের ৯ তারিখ, ওই দেশের ‘আরাফার দিন’ সেটিই। হজযাত্রীদের আরাফার ময়দানে অবস্থানের সঙ্গে তার সম্পর্ক নেই।
আরাফার রোজা প্রত্যেক দেশের ৯ জিলহজে : উপরোক্ত হাদিসের ফজিলতপ্রাপ্তির জন্য সব দেশে অবস্থানরত মুসলিমরা নিজ নিজ দেশের তারিখ অনুসারে জিলহজের ৯ তারিখে রোজা রাখবে—ওই দিন হজযাত্রীদের আরাফায় অবস্থান হোক বা না হোক। কেননা এই রোজার সঙ্গে আরাফার ময়দানের কোনো সম্পর্ক নেই। তাই হজযাত্রীদের জন্য হজ পালনের সুবিধার্থে আরাফার রোজা না রাখা উত্তম। স্বয়ং রাসুলুল্লাহ (সা.)-এরও আরাফায় অবস্থানকালীন রোজা না রাখার বর্ণনা বিশুদ্ধ হাদিসে আছে। (বুখারি, হাদিস : ১৯৮৮)
এর কারণ হলো, এই রোজার সম্পর্ক ৯ জিলহজ তারিখের সঙ্গে। যেদিন যে দেশে ৯ জিলহজ হবে, ওই দেশের জন্য সেটিই ‘ইয়াওমে আরাফা’। যেভাবে ঈদের ক্ষেত্রেও বিধান হলো আরবের সঙ্গে অন্য এমন দূরবর্তী দেশের জন্য ঈদ পালন বৈধ নয়, যার সঙ্গে আরবের তারিখে এক-দুই দিন পার্থক্য থাকে। (মুসলিম, হাদিস : ১০৮৭)
এ ছাড়া আগে উল্লিখিত মুসলিম শরিফের হাদিসে যে আরাফার দিনের রোজা বলতে ৯ জিলহজের কথা বলা হয়েছে, তা অন্য হাদিসে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জনৈকা স্ত্রী বর্ণনা করেন যে রাসুলুল্লাহ (সা.) ৯ জিলহজ তারিখে রোজা রাখতেন।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ২৪৩৭, নাসাঈ, হাদিস : ২৩৭২)
কিছু ভুল-বোঝাবুঝির নিরসন : উপরোক্ত সুস্পষ্ট প্রমাণাদি সত্ত্বেও কিছু ভাই এই ভুল প্রচার করেন যে ‘আরাফা’র রোজা হজযাত্রীদের আরাফায় অবস্থানের দিনের সঙ্গে সম্পৃক্ত—তা বাংলাদেশের ৮ জিলহজ হলেও। এর সপক্ষে কোনো সঠিক দলিল নেই। শুধু মুসলিমের হাদিসে ‘আরাফার দিন’ শব্দটি দিয়েই তাঁরা প্রমাণ করতে চান যে এতে আরাফায় অবস্থানের দিনের কথা বলা হয়েছে। আমরা এর আগে হাদিসটির সঠিক ব্যাখ্যা স্বয়ং অন্য বিশুদ্ধ হাদিসের মাধ্যমেই পেশ করেছি যে হাদিসের উদ্দেশ্য হলো জিলহজ মাসের ৯ তারিখ।
তা ছাড়া এই ভাইদের দাবি মানা হলে অনেক জটিলতা সৃষ্টি হয়। নিম্নে কিছু জটিলতা উল্লেখ করা হলো—
ক.
নির্দিষ্ট সময়ে ইবাদত : ‘আরাফা’র রোজা অন্য ইবাদতের মতো একটি ইবাদত। আর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, রোজা ইত্যাদি প্রতিটি ইবাদতের জন্যই রয়েছে নির্দিষ্ট সময়। প্রতিটি ইবাদত নিজ নিজ এলাকার সময়েই মুসলিমরা আদায় করে। এখন যদি আরাফার রোজাকে আরবের সঙ্গে মিলিয়ে সারা বিশ্বে একই দিনে করতে হয়, তাহলে অন্য ইবাদতে ভিন্নতা কেন হবে?
খ.
রোজার শুরু ও শেষ মুহূর্ত : যদি আরাফার দিনের রোজা আরবের ৯ জিলহজ পালনীয় হয়, তাহলে রোজার শুরু-শেষও আরবের সময়েই করা উচিত। অথচ তা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। কেননা যখন আরবের ৯ জিলহজ সুবহে সাদিক হবে, তখন অনেক দেশের সন্ধ্যারাত, তারা কি তখন রোজা শুরু করবে? তদ্রূপ আরবের ৯ জিলহজ সূর্যাস্তের সময় অনেক দেশের দিন-দুপুর, তারা কি তখনই ইফতার করবে?
গ.
ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ঈদ পালন : পৃথিবীর অনেক দেশে আরবের এক দিন আগেও চাঁদ দেখা যায়। সে ক্ষেত্রে যেদিন আরবের ৯ তারিখ, ওই দিন সেসব দেশে ১০ জিলহজ তথা ঈদুল আজহা। তাদের আরবের সঙ্গে আরাফার রোজা রাখতে হলে ঈদের দিন রোজা রাখতে হবে। অথচ হাদিসে ঈদের দিন রোজা হারাম করা হয়েছে।
ঘ.
বিধান সব সময়ের প্রযোজ্য : ইসলাম শুধু একবিংশ শতাব্দীর যোগাযোগমাধ্যমের সহজলভ্যতার ধর্মই নয়, বরং সর্বযুগের সব মানুষের ধর্ম। সে ক্ষেত্রে যারা কোনো কারণে যোগাযোগমাধ্যম থেকে দূরে, তারা কিভাবে আরবের আরাফার দিন জানতে পারবে?
সারকথা, এটিই প্রমাণিত যে আরবে আরাফায় অবস্থানের সঙ্গে মিলিয়ে সব দেশে আরাফার রোজা রাখা ভুল। এমনকি সব দেশে সম্ভবও নয়। তাই সঠিক হলো, সব দেশে অবস্থানরত মুসলিমরা নিজ নিজ দেশের তারিখ অনুসারে ৯ জিলহজ আরাফার রোজা রাখবে।
এই রকম আরো খবর