একদিকে কঠোর লকডাউন বা বিধি-নিষেধে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি, অন্যদিকে লকডাউন না দিলে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ার শঙ্কা। আবার সপ্তাহখানেক পরেই কোরবানির ঈদ। এমন পরিস্থিতিতে দুই কূল রক্ষার কৌশলী সিদ্ধান্ত নিল সরকার। দেশে সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যার ঊর্ধ্বগতির মধ্যেই ঈদ উদযাপন এবং অর্থনীতির গতি সচল রাখতে আজ মধ্যরাত থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত আট দিনের জন্য লকডাউন শিথিল করা হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সব ধরনের গণপরিবহন চলবে, শপিং মল, দোকানপাটসহ সব কিছু খোলা থাকবে। একই সঙ্গে ঈদের পর ২৩ জুলাই সকাল ৬টা থেকে ৫ আগস্ট মধ্যরাত পর্যন্ত ১৪ দিন আগের চেয়েও কঠোর লকডাউন কার্যকর হবে বলেও গতকাল মঙ্গলবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে।
এদিকে কঠোর বিধি-নিষেধ আট দিনের জন্য শিথিল করার সিদ্ধান্তে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন করোনা মোকাবেলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি বলেছেন, এখনো সংক্রমণ ও মৃত্যুর গতি ঊর্ধ্বমুখী। সে জন্য বিধি-নিষেধ যেভাবে চলছিল, সেভাবেই চলা উচিত ছিল। বিধি-নিষেধ সংক্রমণ বিস্তারের চেইনটা বিচ্ছিন্ন করার কাজ করেছে। কোরবানির ঈদ ঘিরে সব কিছু খুলে দেওয়ায় কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি না মানলে সংক্রমণ আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সরকারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আট দিনের ছাড়ে সংক্রমণ যে আরো বাড়বে, এটা সরকারের মাথায় আছে। এ জন্যই এই সংক্রমণের চেইন ভাঙতে ঈদের পর আবার ১৪ দিনের লকডাউন দেওয়া হয়েছে। সরকারের এই কৌশল কতটা কাজে লাগবে তা সময়ই বলে দেবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকার এই সিদ্ধান্তকেই মন্দের ভালো মনে করছে।
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, সংক্রমণ রোধ করা সরকারের একার দায়িত্ব নয়। প্রত্যেকেরই নিজের জায়গা থেকে সচেতন থাকতে হবে। ঈদ ও অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকারকে সব দিক বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
জানতে চাইলে সরকারের দায়িত্বশীল একটি সূত্র কালের কণ্ঠকে জানান, ঈদকে কেন্দ্র করে মানুষের বাড়ি যাওয়া ঠেকানো যায় না। কঠোর লকডাউন থাকলেও মানুষ ছোট গাড়িতে করে বাড়ি যাওয়া শুরু করে। ইচ্ছা থাকলেও সরকার তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ে নিম্ন আয়ের মানুষ। এবার ঈদে নিম্ন আয়ের মানুষ যেন তুলনামূলক স্বস্তিতে ঘরে ফিরতে পারে তার জন্য অনেক আগেই আদেশ জারি করা হয়েছে। সেই সঙ্গে শিল্প-কারখানায় ঈদ-পরবর্তী সময়ে ১৪ দিনের ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। এতে যারা বাড়ি যাবে তাদের ঢাকায় বা বড় শহরগুলোতে তাড়াহুড়া করে ফিরতে হবে না।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উপসচিব রেজাউল ইসলামের স্বাক্ষরে জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ‘পবিত্র ঈদুল আজহা উদযাপন, জনসাধারণের যাতায়াত, ঈদ-পূর্ববর্তী ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা, দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখার স্বার্থে ১৪ জুলাই (আজ) মধ্যরাত থেকে ২৩ জুলাই সকাল ৬টা পর্যন্ত আরোপিত সব বিধি-নিষেধ শিথিল করা হলো। তবে এ সময়ে সর্বাবস্থায় জনসাধারণকে সতর্ক অবস্থায় থাকা এবং মাস্ক পরিধানসহ স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হবে।’
একই প্রজ্ঞাপনে ২৩ জুলাই সকাল ৬টা থেকে ৫ আগস্ট রাত ১২টা পর্যন্ত সর্বোচ্চ কঠোর বিধি-নিষেধ বা লকডাউন জারিরও ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ঈদ-পরবর্তী এই লকডাউনে শিল্প-কারখানাও বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। অর্থাৎ গত বছর দেশে করোনা প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর এপ্রিলের শুরুতে যেভাবে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল, এবারও কার্যত সেই ধরনের লকডাউন আরোপের ঘোষণা দিল সরকার। তবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রজ্ঞাপনে ‘সাধারণ ছুটি’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘লকডাউনে ফাঁকি দেওয়া গেলেও করোনাকে ফাঁকি দেওয়া যায় না। তার প্রমাণ অতিসংক্রমণ এবং মৃত্যুর উচ্চহার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনার এই উচ্চ সংক্রমণ পরিস্থিতির মধ্যেও ঈদ উৎসবের যে সুযোগ করে দিয়েছেন, তার সদ্ব্যবহার করার জন্য দল-মত-নির্বিশেষে সবার প্রতি আমি আহ্বান জানাচ্ছি।’
এদিকে গতকাল ধর্ম মন্ত্রণালয়ের এক জরুরি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ঈদুল আজহার জামাত মসজিদের পাশাপাশি ঈদগাহ বা খোলা মাঠেও আয়োজন করা যাবে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, করোনাভাইরাসের স্থানীয় পরিস্থিতি ও মুসল্লিদের জীবন-ঝুঁকি বিবেচনা করে স্থানীয় প্রশাসন জনপ্রতিনিধি ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা এবং সমন্বয় করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে পবিত্র ঈদুল আজহার জামাত মসজিদ, ঈদগাহ বা খোলা জায়গায় আয়োজনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। এ জন্য মন্ত্রণালয় ১২ দফা নির্দেশনা দিয়েছে। মহামারির মধ্যে আগের তিনটি ঈদের জামাত ঈদগাহ বা খোলা মাঠে আয়োজন না করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
ঈদ-পরবর্তী লকডাউনে যা মানতে হবে
প্রজ্ঞাপনে ঈদ-পরবর্তী কঠোর লকডাউনের ২৩টি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নির্দেশনাগুলো হলো—সব সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি অফিস বন্ধ থাকবে। সড়ক, রেল ও নৌপথে গণপরিবহন, অভ্যন্তরীণ বিমানসহ সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে। শপিং মল, মার্কেটসহ সব দোকানপাট বন্ধ থাকবে। সব পর্যটনকেন্দ্র, রিসোর্ট, কমিউনিটি সেন্টার ও বিনোদনকেন্দ্র বন্ধ থাকবে। সব ধরনের শিল্প-কলকারখানা বন্ধ থাকবে। জনসমাবেশ হয় এ ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠান যেমন—বিবাহোত্তর অনুষ্ঠান, ওয়ালিমা, জন্মদিন, পিকনিক, পার্টি, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানসহ সব ধরনের অনুষ্ঠান বন্ধ থাকবে। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আদালতের বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা জারি করবেন। ব্যাংকিং, বীমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সেবা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ প্রয়োজনীয় নির্দেশনা জারি করবে। সরকারি কর্মচারীরা নিজ নিজ কর্মস্থলে অবস্থান করবেন এবং দাপ্তরিক কাজ ভার্চুয়ালি অর্থাৎ ই-নথি, ই-মেইল, এসএমএস, হোয়াটসঅ্যাপসহ অন্যান্য মাধ্যমে সম্পন্ন করবেন।
আইন-শৃঙ্খলা এবং জরুরি পরিষেবা, যেমন—কৃষি পণ্য ও উপকরণ যেমন—সার, বীজ, কীটনাশক, কৃষি যন্ত্রপাতি, খাদ্যশস্য ও খাদ্যদ্রব্য পরিবহন, বিক্রয়, ত্রাণ বিতরণ, স্বাস্থ্যসেবা, কভিড-১৯ টিকা, জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) প্রদান কার্যক্রম, রাজস্ব আদায় সম্পর্কিত কার্যাবলি, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, জ্বালানি, ফায়ার সার্ভিস, সরকারি-বেসরকারি টেলিফোন ও ইন্টারনেট, গণমাধ্যম (প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া), বেসরকারি নিরাপত্তাব্যবস্থা, ডাকসেবা, ব্যাংক, ভিসাসংক্রান্ত কার্যক্রম, সিটি করপোরেশন, পৌরসভার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, সড়কের বাতি ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি কার্যক্রম, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, ফার্মেসি ও ফার্মাসিউটিক্যালসসহ অন্যান্য জরুরি বা অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ও সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অফিসের কর্মচারী ও যানবাহন প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয়পত্র দেখিয়ে যাতায়াত করতে পারবেন। বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার কার্যালয় খোলা রাখার বিষয়ে অর্থ বিভাগ প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করবে। জরুরি পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত ট্রাক, লরি, কাভার্ড ভ্যান, নৌযান, পণ্যবাহী রেল এবং ফেরি এ নিষেধাজ্ঞার বাইরে থাকবে। বিমান, সমুদ্র, নৌ ও স্থলবন্দরগুলো এবং বন্দরসংশ্লিষ্ট অফিস এ নিষেধাজ্ঞার আওতাভুক্ত হবে না। কাঁচাবাজার এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কেনা ও বেচার জন্য সময় পাওয়া যাবে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা। এ সময় কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। সংশ্লিষ্ট বাণিজ্য সংগঠন, বাজার কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় প্রশাসন বিষয়টি নিশ্চিত করবে। খুব জরুরি প্রয়োজন, যেমন—ওষুধ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয়, চিকিৎসাসেবা, মৃতদেহ দাফন বা সত্কারের কাজ ছাড়া কোনোভাবেই বাড়ির বাইরে বের হওয়া যাবে না। নির্দেশনা অমান্যকারীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও নির্দেশনায় বলা হয়েছে। টিকা কার্ড দেখিয়ে টিকা নেওয়ার জন্য টিকা কেন্দ্রে যাওয়া-আসা করা যাবে। খাবারের দোকান, হোটেল-রেস্তোরাঁ সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খাবার ক্রয়-বিক্রয় বা অনলাইন অর্ডারের পরিপ্রেক্ষিতে ডেলিভারি দেওয়া যাবে।
আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালু থাকবে এবং বিদেশগামী যাত্রীরা তাদের আন্তর্জাতিক ভ্রমণের টিকিট দেখিয়ে গাড়ি ব্যবহার করতে পারবেন। স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে মসজিদে নামাজের বিষয়ে ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয় নির্দেশনা দেবে। ‘আর্মি ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার’ বিধানের আওতায় মাঠ পর্যায়ে কার্যকর টহল নিশ্চিত করার জন্য সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ প্রয়োজনীয় সংখ্যক সেনা মোতায়েন করবে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্থানীয় সেনা কমান্ডারের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিষয়টি নিশ্চিত করবেন। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জেলা পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়ে সমন্বয় সভা করে সেনাবাহিনী, বিজিবি, কোস্ট গার্ড, পুলিশ, র্যাব ও আনসার নিয়োগ ও টহলের অধিক্ষেত্র, পদ্ধতি ও সময় নির্ধারণ করবেন। একই সঙ্গে স্থানীয়ভাবে বিশেষ কোনো কার্যক্রমের প্রয়োজন হলে সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেবেন। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এ বিষয়ে মাঠ পর্যায়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করবে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় মাঠ পর্যায়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগের বিষয়টি নিশ্চিত করবে। সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮-এর আওতায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীকে আইনানুগ কার্যক্রম গ্রহণের প্রয়োজনীয় ক্ষমতা প্রদান করবেন।
এই রকম আরো খবর