ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দর পার হলেই ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলা। এই আগরতলার সঙ্গেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মুক্তিযোদ্ধারা এখানে প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি নানা পরিকল্পনা করেছিলেন। এখানেই ঠাঁই হয়েছিল হাজার হাজার বাংলাদেশি শরণার্থীর।
আগরতলা বন্দর হয়ে প্রবেশ করে প্রায় দুই কিলোমিটার যেতেই দেখা মিলত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতির। জায়গাটির নাম পোস্ট অফিস চৌমুহনী। একটি ট্যাংক ও কামানের পাশাপাশি সেখানে ছিল মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ। আলোচনা আছে, পাকবাহিনীর কাছ থেকে আটক করা হয় ওই ট্যাংক ও কামান। প্রতিবছরই জাতীয় দিবসে এখানে থাকা স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হতো। স্মৃতিস্তম্ভের সামনেই কংগ্রেস ভবন। ভবনটিকে মুক্তিযোদ্ধারা কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করতেন।
সমালোচনার মুখেই গত বছরের ১৫ নভেম্বর সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় ট্যাংক ও কামান। শেষ পর্যন্ত গত শনিবার করোনা মহামারির কারণে আগরতলা শহরে 'কারফিউ' থাকা অবস্থায়ই ভেঙে ফেলা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সেই স্মৃতিস্তম্ভ।
ত্রিপুরা থেকে প্রকাশিত 'দৈনিক সংবাদ' নামের একটি পত্রিকার প্রতিবেদনে জানা যায়, রাজ্য সরকারের স্মার্ট সিটি প্রকল্পের আওতায় শহরের যানজট নিরসনের লক্ষ্যে স্মৃতিস্তম্ভটি সরিয়ে নেওয়া হয়। শহরের অনতিদূরে লিচু বাগান এলাকায় 'অ্যালবার্ট এক্কা' নামের পার্কে মুক্তিযুদ্ধের ওইসব স্মৃতি রাখা হবে।
এর মধ্য দিয়েই গৌরবগাথার ইতিহাস মুখ লুকাতে যাচ্ছে প্রাচীরের আড়ালে। এ নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে আগরতলার বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে। স্মৃতিস্তম্ভ আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন বাংলাদেশের ২০ বিশিষ্ট নাগরিক।
খোঁজ নিয়ে ও পূর্বে সেখানে যাতায়তের অভিজ্ঞতা থেকে জানা গেছে, পোস্ট অফিস চৌমুহনীটি আগরতলা শহরের প্রাণকেন্দ্রে। সেখানকার গোলচত্বর অর্থাৎ একটি চার রাস্তার মোড়ে ছিল স্মৃতিস্তম্ভটি। আগরতলা শহরে ঢুকতে এ পথটি ব্যবহার করতে হয় বলে সহজেই এটি নজরে আসত। অথচ ওই এলাকায় কখনো তেমন কোনো যানজট লক্ষ করা যায়নি।
গত বছরের ১৫ নভেম্বর সেখানকার ছুটির দিনে দুটি ক্রেন দিয়ে সরিয়ে নেওয়া হয় ট্যাংক ও কামান। এতে স্থানীয়দের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা হয়। এ অবস্থায় পশ্চিম জেলার জেলা শাসক ডা. শৈলেস কুমার যাদব একটি নোটিশ জারি করে জানান, শহরের রাস্তা সম্প্রসারণের জন্য এগুলো সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রথম শহীদ জরয়ান অ্যালাবার্ট এক্কার নামে প্রতিষ্ঠিত আগরতলা লিচু বাগান এলাকার পার্কে এগুলো রাখা হবে।
দুই রাজনৈতিক সংগঠন কংগ্রেস ও সিপিআইএম তখন এর বিরোধিতা করলেও বিষয়টি ধোপে টেকেনি। পার্কের সৌন্দর্য বর্ধনে প্রয়োজনে এসবের রেপ্লিকা তৈরি করে রাখারও দাবি জানানো হয় তখন। এগুলো সরিয়ে নেওয়ার মধ্য দিয়ে ত্রিপুরার ঐতিহ্যকে নষ্ট করার অপচেষ্টা হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়।
দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে এ নিয়ে তীব্র সমালোচনা হয়। বুধবার পত্রিকাটির প্রথম পাতার খবরে বলা হয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস বুকে নিয়ে আগরতলা পোস্ট অফিস চৌমুহনী ভারতীয় সেনাদলের আত্মত্যাগ ও ত্রিপুরাবাসীর অতিথিপরায়ণতার গৌরবগাথা জানান দিত। বিজয়স্তম্ভ গুঁড়িয়ে দিয়ে লিচু বাগানে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগে স্তম্ভিত, নির্বাক আগরতলার জনমানস। সিপিএমের কলাকুশলী, শিল্পীদের সংগঠন 'ত্রিপুরা সংস্কৃতি পরিষদ' এ নিয়ে বিবৃতি দিয়েছে।
এদিকে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ ভেঙে ফেলার খবরে মঙ্গলবার বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিবৃতি পাঠিয়েছেন দেশের ২০ জন বিশিষ্ট নাগরিক। এতে বলা হয়, ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলার কেন্দ্রস্থল পোস্ট অফিস চৌমুহনীর ৪০ ফুট উঁচু শহীদ স্মৃতিস্তম্ভটি ভারত ও বাংলাদেশের গণমানুষের অভিন্ন মুক্তির আকাঙ্ক্ষার সৌহার্দ্যের অন্যতম প্রধান স্মৃতিচিহ্ন, যা দুই দেশের বীর শহীদদের সম্মিলিত রাখিবন্ধনের সাক্ষ্য।
বিবৃতিদাতারা হলেন, লেখক ও ভাষাসংগ্রামী আবদুল গাফফার চৌধুরী, কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক, অধ্যাপক অনুপম সেন, নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ডা. সারওয়ার আলী, অভিনেতা সৈয়দ হাসান ইমাম, সাংবাদিক আবেদ খান, অভিনেত্রী লায়লা হাসান, কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, অধ্যাপক আবদুস সেলিম. মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল্লাহ খান বাদল, বীরপ্রতীক হাবিবুল আলম, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম '৭১-এর কার্যনির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ নূরুল আলম, নাটক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, লেখক-মুক্তিযুদ্ধ গবেষক হারুণ হাবিব, ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, প্রাবন্ধিক মফিদুল হক, ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মেজবাহ কামাল, সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান নূর।
বিবৃতিদাতারা স্মৃতিস্তম্ভটি স্বমহিমায় আগের জায়গায় পুনঃস্থাপনের অনুরোধ জানান।
এই রকম আরো খবর