comparemela.com


তখন সকাল সাড়ে ৬টা। রাজধানীর নতুনবাজারসংলগ্ন ফুটপাতে দেখা গেল হাজারখানেক নারী-পুরুষ। এগিয়ে যেতেই দ্রুত ছুটে এলেন তাঁদের অনেকে। কেউ কেউ জানতে চাইলেন, দিনমজুর হিসেবে কাজের লোক লাগবে কি না। কেউ কেউ বললেন, ‘আমারে কামে (কাজে) নিয়া যান স্যার, আমারে নিয়া যান...।’
জবাবে ‘লাগবে না’ বলে এই প্রতিবেদক নিজের পরিচয় দিতেই কেউ কেউ সরে গেলেন। কেউ কেউ বললেন, ‘পরিচিত কোথাও আমাদের একটা কাজের ব্যবস্থা কইরা দেন। না হইলে অন্তত সরকারের পক্ষ থেকে খাবারের ব্যবস্থা কইরা দেন। ত্রাণের ব্যবস্থা কইরা দেন।’ অন্তত ৫০ জন এমন অনুরোধ করে এই প্রতিবেদকের কাছে নিজেদের নাম ও মোবাইল ফোন নম্বর দেন। বলেন, সম্ভব হলে কোনো ত্রাণের তালিকায় যেন তাঁদের নামগুলো তোলার ব্যবস্থা করা হয়।
গতকাল বুধবার সকালে নতুনবাজারের ফুটপাতে বসে এই ‘মানুষ’ কেনাবেচার হাট। দিনমজুর হিসেবে শ্রম বিক্রির জন্য অপেক্ষায় থাকেন এসব মানুষ। কিন্তু কঠোর লকডাউনের কারণে কাজ প্রায় মিলছেই না। জুটছে না সরকারি সহায়তাও। ফলে পরিবার-পরিজন নিয়ে অনাহার-অর্ধাহারে খুব কষ্টে কাটছে তাঁদের দিন।
সেখানে কথা হয় কুমিল্লার আক্তার হোসেনের (২৮) সঙ্গে। আক্তার প্রায় ১০ বছর ধরে রাজধানীর নূরেরচালা এলাকায় পরিবার নিয়ে থাকেন। গত এক সপ্তাহ প্রতিদিনই কাজের সন্ধানে বের হয়ে মাত্র দুই দিন তাঁর কাজ জোটে। তা-ও অন্য সময়ের তুলনায় ২০০ টাকা কমে কাজ করেছেন। তিনি বলেন, ‘সরকারের দেওয়া লকডাউন বড়লোকের লাইগা, আমাগো গরিবের পেডে লাথি; যেখানে দিনে আনি দিনে খাই। লকডাউন শুরুর পর থেইকা প্রত্যেক দিন কামের জন্য বাইরও হইছি। মাত্র দুই দিন কাম পাইছি। ঘরে সদাইপাতি না দিতে পাইরা পরিবার নিয়া কষ্ট করতাছি। এসব কষ্ট শুনারও কেউ নাই। সরকার শুনছি খাদ্য দিতাছে। আমি পাই নাই। এখন পর্যন্ত পরিচিত কেউ পাইছে হুনিও নাই।’
আক্তারের সঙ্গে কথা বলার সময়ই ঘিরে ধরেন আকবর, নাছির, জোলেখা, আবেদা, মোরশেদ, আসাদুল, সুমন, ভুট্টু, গুলেছা, শিরিনা, পারভিন, সাফিয়া, আমেনা, হারিছ, জুয়েল, মাছুম, আনোয়ার, আব্দুল্লাহ, সুরুজ বানু, কুলছু, পিয়ারা, দুলাল, রাহুল, হীরা, মতিয়ুর, আব্বাসসহ অন্তত ৫০ জন নারী-পুরুষ। সবাই শ্রম বিক্রির জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
ঘড়ির কাঁটা যখন সাড়ে ৭টার ঘরে, তখনো সেখানে কাউকে শ্রম বিক্রির সুযোগ পেতে দেখা গেল না। অর্থাৎ রুটি-রুজির ব্যবস্থা হয়নি। কোনো মোটরসাইকেল বা প্যান্ট-শার্ট পরা কেউ এসে থামলেই তাঁরা দল বেঁধে ছুটে গিয়ে জানতে চান, কাজের লোক লাগবে কি না। জানান, তাঁরা ইট, বালু, সিমেন্ট ওঠানো-নামানো, টাইলস পরিষ্কার, ভবন ঢালাই, রাজমিস্ত্রির সহযোগী, বাসা ধোয়ামোছা, রান্নাবান্না, মাটি কাটা, ইট পরিষ্কার ও ভাঙানো, টাইলস পুডিংসহ সব কাজই পারেন।
কড়াইল বস্তিতে থাকেন টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার সেলিম মিয়া (৩২)। তিনি বলেন, ‘রোজ রোজ কাজের লাইগা আই, কাজ না পাইয়া দুঃখ লইয়া বাসাত যাই। এখন পর্যন্ত লকডাউনে কারোর কাছ থেইকা কিচ্ছু (সহায়তা) পাইছি না। সরকারের কাছে অনুরোধ, আর লকডাউন না দিক। দিলেও আমাদের গরিব মানুষকে খাবার দিক। খিদার জ্বালা বড় জ্বালা।’
নতুনবাজার এলাকার সাঈদনগরে থাকেন মনু মিয়া (৫৫)। তিনি বলেন, ‘পরিবারের ছোড-বড় ৯ জনের খাওনের মুখ। দুইজন কাম কইরা দিনে আইনা দিনে খায়। লকডাউনের পর এক দিনও কেউ কামে যাইতারি নাই। আগে রোজ ৭০০ টাকায় কামে যাইতাম, এখন ৩০০-৪০০ হইলেও চইলা যাইয়ুম। প্রত্যেক দিন কাম না পাইয়া, খালি হাত নিয়া ঘরে যাওয়ার চেয়ে মাঝে মাঝে মনে হয় মইরে যাই। ছেলে-মাইয়ারা হাতের ফিল চাইয়া থাহে। তখন কী যে খারাপ লাগে!’
স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পর শরীয়তপুরের চার সন্তানের জননী পিয়ারা বেগম ঢাকায় এসে থাকেন নদ্দায়। সংসার চালাতে বাধ্য হয়ে বছর দুয়েক ধরে নতুনবাজার এলাকায় ভাসমান শ্রমিকের হাটে কাজের জন্য গিয়ে দাঁড়ান। এত দিন কোনো রকমে ঘরভাড়া ও ছেলে-মেয়ের ভরণ-পোষণ চালাতে পারলেও লকডাউনে কাজের জন্য বের হয়েও আর কাজ পাচ্ছেন না। তিনি বলেন, ‘আগে পোলা-মাইয়া নিয়া কোনো রকমে চলতে পারলেও এবার আর পারছি না। দোকানে বাকি খাইতে খাইতে দোকানদারও আর বাকি দিতে পারবে না বলে দিছে। এখন সরকার আমাদের মতো গরিবদের সাহায্য না করলে না খাইয়া মরতে হইব।’
করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির আবার অবনতি হওয়ায় সরকার দুই দফায় ১ জুলাই থেকে ১৪ দিনের জন্য ২১ দফা কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে। লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকেই নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষ খাদ্যকষ্টসহ বিভিন্ন ধরনের সংকটের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। লকডাউনে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া রাস্তায় বের না হওয়ার নির্দেশনা রয়েছে। যারা বের হচ্ছে, বেশির ভাগই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে। এ অবস্থার মধ্যেও থেমে নেই নিম্ন আয়ের মানুষের কাজের সন্ধানে বের হওয়া। কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই তাঁদের কাজ না পেয়ে হতাশ হয়ে দুশ্চিন্তা নিয়ে ঘরে ফিরতে হচ্ছে।
সকালে যাঁরা মোবাইল ফোন নম্বর দিয়েছিলেন এই প্রতিবেদককে, বিকেলে তাঁদের মধ্যে পাঁচজনকে ফোন করলে তাঁরা জানান, কারো ভাগ্যেই কাজ জোটেনি। তাঁদের মধ্যে একজন রাসেল মিয়া, যাঁর বাড়ি দিনাজপুরের পার্বতীপুরে, তিনি জানান, গত সাত দিন ধরে কাজের সন্ধানে বের হয়ে মাত্র এক দিন পেয়েছিলেন। লকডাউনের আগে কাজ করানোর জন্য লোকজন মিরপুর, আব্দুল্লাহপুর, টঙ্গীসহ বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যেত। এখন বাস বন্ধ থাকায় কেউ নেয় না।
ভাটারা থানার খন্দকারবাড়ি মোড় এলাকায় থাকেন নাজমা আক্তার (৩৫)। তিনিও এই হাটের নিয়মিত শ্রমিক। কিন্তু এই লকডাউনে এক দিনও কাজে যেতে পারেননি। নাজমা বলেন, ‘পাঁচজনের ফ্যামিলি। আমার রোজগারেই সংসার চলে। কিন্তু এখন কাজকাম নাই। কিভাবে চলমু পথ পাইতাছি না। সরকার আমাগো বাঁচাইব না? এভাবে কি চলা যায়?’
এই রকম আরো খবর

Related Keywords

Abdullahpur ,Rangpur ,Bangladesh ,Bhatara ,Bangladesh General ,Tangail District ,Dhaka ,Parbatipur ,Mirpur ,Suruj Banu ,Russell Mia ,Salim Mia ,Piara Begum , ,Kame Near Go Sir ,Near Go Sir ,Meters Hussein ,Masonry Associate ,Tangail District Salim Mia ,District Parbatipur ,Hat Regular ,அப்துல்லாபுர் ,ரங்க்பூர் ,பங்களாதேஷ் ,டாக்கா ,பர்பதிபூர் ,மிற்புர் ,ரஸ்ஸல் மியா ,சலீம் மியா ,பியாரா பிச்சம் ,

© 2024 Vimarsana

comparemela.com © 2020. All Rights Reserved.