কভিড-১৯ সংক্রমণ রোধে আজ থেকে দেশজুড়ে সাত দিনের কঠোর লকডাউন শুরু হয়েছে। বৃহস্পতিবার (০১ জুলাই) ভোর ৬টা থেকে শুরু হওয়া এই লকডাউন চলবে ৭ জুলাই মধ্যরাত পর্যন্ত।
এবারের লকডাউন কঠোরভাবে বাস্তবায়নে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও আনসারসহ সেনাবাহিনী মাঠ থাকবে। এই সময়ে জনসাধারণ ও যানবাহন চলাচল এবং বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পরিচালনার বিষয়ে কঠোর বিধি-নিষেধ ও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে বুধবার (৩০ জুন) প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে সরকারি-বেসরকারি সব অফিস, যানবাহন ও দোকানপাট বন্ধ রাখার কথা বলা হয়েছে। এই সময়ে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বের হলে কঠোর শাস্তির মুখে পড়তে হবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে কঠোর বিধি-নিষেধ তথা লকডাউন কার্যকরে আটঘাট বেঁধে মাঠে নামছে সরকার। কেন্দ্রীয়ভাবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি ছাড়াও বিভিন্নভাবে বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ে কড়া লকডাউন নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় বার্তা দেওয়া হচ্ছে। সর্বাত্মক লকডাউন সফল করতে ঢাকায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, ঢাকা বিভাগীয় কমিশন ও ঢাকা জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা গতকাল বুধবার দফায় দফায় বৈঠক করেছেন।
প্রজ্ঞাপন জারির পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ও কার্যালয় সচিব ৬৪ জেলার জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও আট বিভাগের বিভাগীয় কমিশনারদের সঙ্গে জুম প্ল্যাটফর্মে এক ঘণ্টার বেশি বৈঠক করেছেন। এতে কার্যালয়ের তরফ থেকে দেশজুড়ে সর্বাত্মক লকডাউন দৃশ্যমান করতে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
বৈঠক সূত্রে জানা যায়, সরকারের সর্বোচ্চ শক্তি আপনাদের দেওয়া হয়েছে। লকডাউন সফল করা ছাড়া কোনো বিকল্প সরকার দেখতে চায় না। সরকারপ্রধানের বার্তা দিয়ে বলা হয়েছে, বিশ্বের অন্যতম জনবহুল দেশ হওয়ার পরও সরকারপ্রধানের দূরদর্শিতায় করোনা মোকাবেলায় বাংলাদেশ অনেক উন্নত দেশের চেয়ে ভালো অবস্থানে আছে। বর্তমান পরিস্থিতি যাতে খারাপের দিকে না যায়, মানুষ যাতে বিপন্ন অবস্থায় না পড়ে, এটা চান প্রধানমন্ত্রী। তাই সাধারণ মানুষকে আস্থায় রেখে দেশের সব স্থানে দৃশ্যমান লকডাউন ফুটিয়ে তুলতে হবে।
এদিকে কঠোর লকডাউন বাস্তবায়নে গতকাল দেশের আটটি বিভাগে ১০৬ কর্মকর্তাকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৫৫, খুলনা বিভাগে ১২, রাজশাহীতে ছয়, রংপুরে দুই, সিলেটে দুই, ময়মনসিংহে ৯, বরিশালে পাঁচ এবং চট্টগ্রাম বিভাগে ১৫ জন রয়েছেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রেষণ-২ শাখার উপসচিব আবু কায়সার খান স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, এসব কর্মকর্তা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা অনুযায়ী মোবাইল কোর্টের তফশিলভুক্ত আইন অনুযায়ী তাঁদের জন্য নির্ধারিত এলাকায় দায়িত্ব পালন করবেন। এসব কর্মকর্তার ওপর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা অপর্ণ করে ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে সংযুক্তি দেওয়া হয়েছে। ক্যাটাগরি (এ, বি, সি) অনুযায়ী প্রতিটি জেলায়ই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট থাকেন। উপজেলা পর্যায়ে ইউএনও ও এসি ল্যান্ডরা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালন করেন। এবার লকডাউন উপলক্ষে উল্লিখিতসংখ্যক কর্মকর্তাদের সরকারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে গতকাল প্রজ্ঞাপন জারির পর জেলা প্রশাসকরা সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিয়ে একাধিক বৈঠক করেছেন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জেলা পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিয় সমন্বয় সভা করে সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, র্যাব ও আনসার নিয়োগ এবং টহলের অধিক্ষেত্র, পদ্ধতি সমন্বয় ও সময় নির্ধারণ করবেন। সেই সঙ্গে স্থানীয়ভাবে বিশেষ কোনো কার্যক্রমের প্রয়োজন হলে সে বিষয়ে পদক্ষেপ নিবেন।
গতকাল রাতে রংপুর বিভাগের এক ডিসি নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারির পর জেলা পর্যায়ের করোনাসংক্রান্ত কমিটির সঙ্গে একটি বৈঠক করেছি। এখন (গতকাল রাত ৮টা) সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, র্যাব ও আনসারের সঙ্গে বৈঠক হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘আশা করি নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা কঠোর লকডাউন বাস্তবায়ন করতে পারব।’ রাজশাহী বিভাগের আরেক ডিসি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, বিভাগীয় কমিশনার অফিসসহ সব দিকের ব্যাপক উদ্যোগ ও প্রস্তুতির মাধ্যমে আমরা কাজ করছি, আশা করি সরকারের প্রত্যাশা মতো কড়া লকডাউন আমরা দেখাতে পারব।’
প্রজ্ঞাপনে যা আছে : গতকাল করোনা রোগের বিস্তার ঠেকাতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উপসচিব রেজাউল ইসলামের স্বাক্ষরে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এই আদেশ আজ সকাল ৬টা থেকে ৭ জুলাই মধ্যরাত পর্যন্ত কার্যকর থাকবে। সর্বশেষ জারি করা এই আদেশ অনুযায়ী আজ থেকে পুরোপুরি বন্ধ থাকবে সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি অফিস। সড়ক, রেল ও নৌপথে চলাচল বন্ধ থাকবে। অভ্যন্তরীণ বিমান চলবে না। শপিং মল, মার্কেট, দোকানপাট খোলা যাবে না। পর্যটন কেন্দ্র, রিসোর্ট, কমিউনিটি সেন্টার ও বিনোদনকেন্দ্রও বন্ধ থাকবে। জনসমাবেশ, সামাজিক অনুষ্ঠান করা যাবে না। তবে শর্তযুক্ত অবস্থায় খোলা থাকবে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট। বিদেশগামী যাত্রীরা আন্তর্জাতিক ভ্রমণের টিকিট দেখিয়ে গাড়ি ব্যবহার করে যাতায়াত করতে পারবেন। জরুরি ভিসা সেবার জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী খোলা থাকবে বিদেশি দূতাবাস। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও কাঁচাবাজার সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা খোলা থাকবে। খাবারের দোকান, হোটেল-রেস্তোরাঁ থেকে শুধু খাবার বিক্রির জন্য সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা রাখা যাবে। ফলে রেস্তোরাঁয় বসে খাওয়া যাবে না। টিকাকার্ড দেখানোর শর্তে যাওয়া যাবে টিকাকেন্দ্রে। ব্যাংক সকাল ১০টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত সপ্তাহে চার দিন (সোম-বৃহস্পতিবার) খোলা থাকবে। প্রত্যেক চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একজন করে ম্যাজিস্ট্রেট শারীরিক উপস্থিতিতে দায়িত্ব পালন করবেন। হাইকোর্ট বিভাগের তিনটি বেঞ্চ ভার্চুয়ালি বিচারকাজ চালাবে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
অন্যদিকে শর্তহীন খোলা থাকবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গণমাধ্যম, কৃষিপণ্য ও উপকরণ, খাদ্যশস্য ও খাদ্যদ্রব্য পরিবহন, ত্রাণ বিতরণ, স্বাস্থ্যসেবা, রাজস্ব সম্পর্কিত, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস-জ্বালানি, ফায়ার সার্ভিস, সরকারি-বেসরকারি টেলিফোন ও ইন্টারনেট, বেসরকারি নিরাপত্তা ব্যবস্থা, ডাকসেবা, ফার্মেসি, ফার্মাসিউটিক্যালসসহ অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ও সেবা। এ ছাড়া ট্রাক-লরি, কাভার্ড ভ্যান, কার্গো ভেসেল, বিমান, সমুদ্র, নৌ ও স্থলবন্দর এবং সংশ্লিষ্ট অফিস ও শিল্প-কারখানা খোলা থাকবে। উল্লিখিত বিষয়গুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অফিসের কর্মচারী ও যানবাহন প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয়পত্র দেখিয়ে যাতায়াত করতে পারবে।
অকারণে বের হলেই গ্রেপ্তার : এদিকে প্রজ্ঞাপন জারির পর লকডাউনের কঠোর শর্ত মেনে চলার ব্যাপারে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শফিকুল ইসলাম। গতকাল ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘরের বাইরে বের হতে পারবে না। অকারণে ঘর থেকে বের হলে তাকে দণ্ডবিধির ২৬৯ ধারার (সংক্রমণ রোগ ছড়ানোর অপরাধ) মামলায় গ্রেপ্তার করা হবে। ভ্রাম্যমাণ আদালতে তাত্ক্ষণিক শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।’
নাগরিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘পুলিশ আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে যতটা কঠোর হবে, আপনার পরিবার-সন্তান ততটাই নিরাপদে থাকবে। আপনারা আমাদের সহযোগিতা করবেন, পুলিশের সঙ্গে তর্ক-বিতর্কে জড়িয়ে আমাদের ফাঁকি দিতে পারবেন, পুলিশের কাজের ভিডিও করে ভাইরাল করে পুলিশকে সমালোচনার মুখে ফেলতে পারবেন, তবে সন্তান ও পরিবারকে সংক্রমণ থেকে দূরে রাখতে পারবেন না।’
তিনি বলেন, ‘সড়কে কোনো ধরনের যান্ত্রিক বাহন আমরা চলতে দেব না। তবে সংগত কারণ থাকলে বা নিত্যপ্রয়োজনীয় বাজারে যেতে হলে আমরা তাদের রিকশা ব্যবহারের অনুরোধ করব।’
কুরিয়ার সার্ভিসের গাড়ির চলাচলের ব্যাপারে শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘যেহেতু কুরিয়ার সার্ভিস কাভার্ড ভ্যান ব্যবহার করে এবং যাত্রী পরিবহন করে না, সে ক্ষেত্রে তারা চলাচল করতে পারবে।’
গতকাল বিকেলে ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা নির্দেশনায় বলা হয়েছে, প্রত্যেককে নিজ নিজ বাসা থেকে অজু করে, সুন্নত নামাজ ঘরে আদায় করে মসজিদে আসতে হবে এবং অজু করার সময় কমপক্ষে ২০ সেকেন্ড সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে। অন্য সব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান-উপাসনালয়ে প্রবেশের ক্ষেত্রে মাস্ক পরা, হ্যান্ড স্যানিটাইজার-সাবান দিয়ে হাত ধোয়াসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে সামাজিক ও শারীরিক দূরত্ব যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে।
সীমিত পরিসরে চলবে উচ্চ ও নিম্ন আদালত : পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি, হাইকোর্ট বিভাগের তিনটি একক বেঞ্চ এবং সারা দেশে সব জেলায় চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একজন করে ম্যাজিস্ট্রেট, মহানগর এলাকায় চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একজন করে ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্ব পালন করবেন।
চলাচলে বাধা নেই ভিসাপ্রত্যাশীদের : পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন গতকাল প্রজ্ঞাপন জারির পর সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, লকডাউনে বিদেশি দূতাবাসগুলো জরুরি ভিসা সেবার জন্য খোলা থাকবে। ভিসা নিতে শিক্ষার্থীরা দূতাবাসে যাতায়াতের সুযোগ পাবেন।
মাঠে থাকবে সেনাবাহিনী : গতকাল আইএসপিআরের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, করোনার বিস্তার রোধে সার্বিক কার্যাবলি/চলাচলে বিধি-নিষেধ কার্যকর করার জন্য ‘ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার’-এর আওতায় আজ বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা থেকে ৭ জুলাই মধ্যরাত পর্যন্ত সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন থাকবে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্থানীয়ভাবে সেনা মোতায়েনের বিষয়ে প্রয়োজনীয় সমন্বয় করবেন।
এই রকম আরো খবর