comparemela.com


Anandabazar
গোবলয়-শাসিত ভারত?
সেন্ট্রাল ভিস্টা প্রকল্পের পিছনে আছে বড় রাজনৈতিক হিসেব
সুমিত মিত্র
১৫ জুন ২০২১ ০৫:২৬
দিল্লিতে রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে ইন্ডিয়া গেট পর্যন্ত তিন কিলোমিটার দীর্ঘ ‘সেন্ট্রাল ভিস্টা’ দিল্লিবাসীর গর্বের বস্তু। তাকে দেশের বিগত একশো বছরের স্মৃতি ও সংস্কৃতি থেকে দুমড়ে মুচড়ে আলাদা করে তার চেহারা বদলের যে প্রক্রিয়া শুরু করেছে নরেন্দ্র মোদীর সরকার, তা নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত সব ইতিহাস-সচেতন ভারতীয়। কিন্তু চিন্তিত হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হল ওই সেন্ট্রাল ভিস্টার সেই অঙ্গটি নিয়ে, যেখানে নির্মিত হচ্ছে ভারতের নতুন সংসদ ভবন। সেখানে নতুন লোকসভার সদস্যসংখ্যা ভবিষ্যতে বাড়তে চলেছে। তার ফলে তুলনামূলক ভাবে উত্তর ভারতের গোবলয়ের প্রতিনিধিত্বের আকার একদম খর্ব করে দেবে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের ছোট কিন্তু প্রগতিশীল রাজ্যগুলিকে। গোবলয়ের বর্তমান মুখ্য পরিচালক মোদীর ভারতীয় জনতা পার্টি। অর্থাৎ, বিজেপি যে সেন্ট্রাল ভিস্টা প্রকল্প ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের যথেষ্ট আগে শেষ করাতে চাইছে, তার পিছনে তবে কাজ করছে হিন্দু জাতীয়তাবাদের একটি বড় পরিকল্পনা?
এই বিষয়ে আলোচনা অগ্রসর করতে মনে করতে হবে সংবিধানের ৮১ অনুচ্ছেদ, যার ২(ক) উপধারা অনুযায়ী, “(লোকসভায়) প্রতি রাজ্য প্রদত্ত হবে ততগুলিই আসন, যা তার জনসংখ্যার একটি অনুপাত অনুসারে নির্দিষ্ট হবে, এবং সেই অনুপাত যত দূর সম্ভব সব রাজ্যে সমান হবে।” অর্থাৎ, সংবিধান চাইছে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব। তার জন্য তো জনসংখ্যা হ্রাসবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে লোকসভায় রাজ্যগুলির আসনসংখ্যা পুনরায় ধার্য করা প্রয়োজন! বস্তুত, ঠিক পরবর্তী ৮২ অনুচ্ছেদ বলছে, প্রতি দশকে জনশুমারি অনুযায়ী ধার্য হবে লোকসভায় রাজ্যপ্রতি আসনসংখ্যা।
কিন্তু তা মুখে বলা যত সহজ, কাজে পরিণত করা ততই শক্ত। এক বড় সমস্যা, হিন্দিভাষী দুই বৃহৎ রাজ্য উত্তরপ্রদেশ ও বিহারে অবিরল জন-বিস্ফোরণ— লোকসভার আসনে তা প্রতিফলিত হলে অন্যান্য রাজ্যবাসীর কাছে তা কাম্য হতে পারে না। গণতন্ত্রকে তা ঠেলে দেবে সংখ্যাগুরুবাদের দিকে, যার বিপদ সম্পর্কে চল্লিশের দশকের সংবিধান প্রণেতারা কিন্তু সবিশেষ অবহিত ছিলেন না। লোকসভায় রাজ্যওয়ারি আসনবণ্টনের লক্ষ্যে ১৯৭১ সালের জনশুমারি তথ্য ব্যবহৃত হওয়ার কথা ছিল ১৯৭৬ সালে পূর্বনির্দিষ্ট সাধারণ নির্বাচনের জন্য। কিন্তু ১৯৭৫ সালে ইন্দিরা গাঁধী জারি করেন জরুরি অবস্থা, এবং সেই সুযোগে চালু করেন সরকারি জন্ম-নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প। সঞ্জয় গাঁধীর পরিচালনায় এই প্রকল্প শুরু হয় যুদ্ধকালীন তৎপরতা সহকারে। যে সব রাজ্য জন্ম-নিয়ন্ত্রণের বিরোধী, তাদের প্রতিনিধিত্ব বাড়তে দেওয়া নিয়ে ইন্দিরা সরকারের আপত্তি ছিল। তাই এল ১৯৭৬ সালের ৪২তম সংবিধান সংশোধন— তাতে বলা হয়, আসন পুনর্বণ্টন এখন নয়, ২০০১ সালের জনগণনা অনুসারে তা করা হবে।
সেটাও শেষ অবধি সম্ভব হল না। ২০০২ সালে এল ৮৪তম সংবিধান সংশোধন। স্থির হল, আসন-বণ্টন নির্ধারিত হবে একদম ২০২৬ সালের নির্বাচনের পরবর্তী দশকান্তিক জনশুমারির (২০৩১ সালের) তথ্য অনুযায়ী। কিন্তু এরই মধ্যে দক্ষিণের তামিলনাড়ু বা কেরল, এমনকি উত্তরের পঞ্জাবের সঙ্গেও কোনও সঙ্গতি না রেখে গোবলয়ের জনসংখ্যা বেড়েই চলেছে। সম্প্রতি কার্নেগি এনডাওমেন্টের সমাজবিজ্ঞানী মিলন বৈষ্ণব ও তাঁর এক সহকর্মী এক গবেষণা-প্রবন্ধে দেখিয়েছেন, যদি ২০২৬ সালেই জনসংখ্যার সমানুপাতিক হারে আসনবণ্টন হয়, তা হলে কী দাঁড়ায় পরিস্থিতি। সে ক্ষেত্রে কেরলের এখনকার ২০টি আসন ২০২৬ সালে হয়ে যাবে ১২। তামিলনাড়ুর আজকের ৩৯ নেমে আসবে ৩১-এ। পশ্চিমবঙ্গের আসনও কমে আসবে ৪২ থেকে ৩৮-এ। এ দিকে উত্তরপ্রদেশের ৮০ হবে ৯১ এবং বিহারের ৪০ পৌঁছবে ৫০-এ।
রাজ্যে রাজ্যে প্রতিনিধিত্বের গরমিল যে কতটা প্রকট, তা বোঝা যায় উত্তরপ্রদেশ ও তামিলনাড়ু, এই দুই রাজ্যের ২০১৯ সালের লোকসভা সদস্য-পিছু জনসংখ্যা থেকে। তা যথাক্রমে ৩০ লক্ষ ও ১৭ লক্ষ। এর মধ্যে সমতা আনয়নের উপায় হতে পারে উত্তরপ্রদেশের সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি ও তামিলনাড়ুর সঙ্কোচন। বৈষ্ণবের মতে, কোনও রাজ্যই রাজি হবে না লোকসভায় তার সদস্যসংখ্যা কমিয়ে আনতে। তাই তাঁর বিকল্প নির্দেশ, কোনও রাজ্যেরই আসনসংখ্যা না কমিয়ে শুধু জনসংখ্যার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়িয়ে দেওয়া হোক আসন। সেই হিসেবে ২০২৬ সালের সম্ভাব্য জনসংখ্যা অনুযায়ী উত্তরপ্রদেশ থেকে নির্বাচিত হবে ১৪৩ জন লোকসভা সদস্য ও বিহার থেকে ৭৯। এবং সেই বিচিত্র লোকসভার মোট সদস্যসংখ্যা হবে— ৮৪৮!
মুশকিল হল, এর ফলে হয়তো ভারতীয় লোকসভা পাটিগণিত-সম্মত হবে, কিন্তু গণতন্ত্রের একটি মূল শর্ত সেখানে লঙ্ঘিত হবে। সেই শর্ত হল, সংখ্যাগুরুর উন্নতির জন্য সংখ্যালঘু যেন না হারায় তার সম্মান। উত্তরপ্রদেশের ১৪৩ জন লোকসভা সদস্যকে পাশে নিয়ে কেমন করে কেরলের ২০ জন সদস্য রক্ষা করবেন তাঁদের রাজ্যের সম্মান? উত্তরপ্রদেশ, বিহার বা মধ্যপ্রদেশে এখনও এক বিপুল সংখ্যক মানুষ বাস করেন যাঁরা শিক্ষায়-দীক্ষায় বাকি ভারতের থেকে অনেক পিছিয়ে, এবং যাঁরা নরেন্দ্র মোদীর হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন। সেই রাজনীতি প্রধানত সঙ্কীর্ণ জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী, ইসলামবিরোধী, এবং, মুখে না বললেও, নারীবিদ্বেষী। কয়েক দশক আগেও বিহার, উত্তরপ্রদেশ ও অন্য হিন্দিভাষী রাজ্যগুলি ছিল ভারতে মধ্য ও নিম্নবর্গের জাতিভিত্তিক রাজনীতির ঝটিকাকেন্দ্র। আজ তারাই ভারতীয় জনতা পার্টির গণসমর্থনের উৎস। ২০১৯ সালের নির্বাচনে বিজেপি ও তার সহযোগীদের ৩৫২টি আসনের ১৯৬টিই (৫৫.৬৮ শতাংশ) এসেছে হিন্দিভাষী রাজ্য থেকে। বিজেপিকে মুক্তহস্তে ভোট দিয়েছে এমন সব হিন্দিভাষী রাজ্য, যাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার খুবই উঁচু।
সুতরাং, খুবই সম্ভব যে এই বার সেন্ট্রাল ভিস্টা তছনছ করে সাত-তাড়াতাড়ি অতিকায় নতুন সংসদ ভবন নির্মাণের অন্তরালে যে ফন্দিটি ঘুরছে তা হল, যে কোনও উপায়ে এখনই লোকসভায় রাজ্যওয়ারি আসনসংখ্যা পুনর্নির্ধারিত করা আগামী ২০২৪-এর নির্বাচনের জন্য। এবং তা করা হবে ২০৩১ সালের বদলে ২০২১-এর জনগণনার ভিত্তিতে। তা হলে উত্তরপ্রদেশের আসনসংখ্যা হয়তো ১৪৩ হবে না, তবে ১৩০ হবেই। আগামী নির্বাচন নিয়ে মোদীবাহিনীর দুশ্চিন্তার কারণ আছে। কোভিড-১৯ ভাইরাসের নানা অবতারের আবির্ভাব, তার আর্থিক, সামাজিক এবং জনস্বাস্থ্য-ঘটিত প্রতিক্রিয়া বিপন্ন করেছে মোদীর সযত্নলালিত সুশাসক পরিচয়টিকে। “মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়” স্লোগানের এখন করুণ অবস্থা। এই সত্য বারংবার জানান দিচ্ছে বিভিন্ন নির্বাচনের ফলাফলে। উত্তরপ্রদেশের সাম্প্রতিক পঞ্চায়েত নির্বাচনেও বিজেপি পিছিয়ে পড়েছে মূল স্থানীয় প্রতিদ্বন্দ্বী সমাজবাদী পার্টির তুলনায়। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে প্রচুর ঢক্কানিনাদ সত্ত্বেও বিজেপির তুমুল পরাজয় কালিমালিপ্ত করেছে মোদীর ‘বিজয়ী বীর’ ভাবমূর্তিকে।
লোকসভায় সদস্যসংখ্যা ২০৩১ জনশুমারির বদলে ২০২১-এর সঙ্গে জড়িত করতে হলে প্রয়োজন আর এক সংবিধান সংশোধন। তা সম্ভব একমাত্র সংবিধানের ৩৬৮ অনুচ্ছেদ-বলে। উদ্দেশ্য হল— সংসদে রাজ্যের প্রতিনিধিত্বের পরিবর্তন, যার জন্য ৩৬৮ অনুচ্ছেদের ২(ঘ) উপধারা-মতে প্রয়োজনীয় এক বিশেষ প্রকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা— শুধু সংসদে নয়, অন্তত অর্ধেক রাজ্য বিধানসভায়। রাজ্যসভা ও লোকসভায় সমর্থন চাই অন্যূন অর্ধেক নথিভুক্ত সদস্যের; সমর্থক সদস্যদের সংখ্যা হতে হবে মোট হাজির সদস্যের দুই-তৃতীয়াংশ। এর পর সাধারণ গরিষ্ঠতা অর্জন করতে হবে অন্তত অর্ধেক বিধানসভা থেকে। কাজটি খুবই শক্ত, কিন্তু অসম্ভব নয়। লোকসভা তো বর্তমান হিসেবে বিজেপির কাছে ‘কেকওয়াক’। তবে রাজ্যসভা কঠিন জায়গা। সেখানে সরকার ও বিরোধী পক্ষ এখন ১১৬ আসন নিয়ে সমানে সমানে। তবে ‘বিরোধী’র মধ্যে রয়েছে বেশ কিছু প্রচ্ছন্ন সমর্থক। যেমন, অন্ধ্রপ্রদেশে ওয়াইএসআর-এর দল, বা তেলঙ্গানায় টিআরএস। তা ছাড়া রাজ্য থেকে সংশোধন পাশ করানোর জন্যও এটাই প্রকৃষ্ট সময়। এখন ১৮টি রাজ্যে বিজেপি নিজে বা তার সহযোগীদের নিয়ে ক্ষমতায় আসীন।
আগামী বছর উত্তরপ্রদেশে ভরাডুবি হলে হয়তো পরিস্থিতি পাল্টে যেতে পারে আগাগোড়া। অন্যথায়, সংসদে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার জন্য উত্তর ভারতের গোবলয়কে কব্জা করতে পারলে আরও কয়েক দশক চলতে পারে নিরবচ্ছিন্ন হিন্দুত্ববাদী শাসন। নামে গণতান্ত্রিক, কাজে স্বৈরতান্ত্রিক।
Advertisement

Related Keywords

Madhya Pradesh ,India ,Uttar Pradesh ,Bihar ,Tamil Nadu ,Lok Sabha ,Indira Gandhi ,Rajya Sabha ,Kerala John ,Lok Sabha States ,John Lok Sabha ,Haii Hai ,Sanjay Gandhi ,Junior ,Bengal Legislative Assembly ,India New Parliament Building ,Narendra Modi Hindu National ,Parliament Building ,Csp Party ,Modi India Janata Party ,New Delhi Rashtrapati Bhavan ,Narendra Modi ,Being India New Parliament Building ,New Lok Sabha ,India Republic Small But ,Central Project ,Constitution Section ,State Uttar Pradesh ,Constitution But ,Project Start ,South Tamil Nadu ,North Punjab ,Milan Vaishnava ,West Bengal ,Available Uttar Pradesh ,Lok Sabha Her ,Exotic Lok Sabha ,India Lok Sabha ,Uttar Pradesh John Lok Sabha ,Mammoth New Parliament Building ,Her Financial ,Modi Haii Hai ,West Bengal Legislative Assembly ,Modi Image ,State Assembly ,Neck ,Andhra Pradesh ,மத்யா பிரதேஷ் ,இந்தியா ,உத்தர் பிரதேஷ் ,பிஹார் ,தமிழ் நாடு ,லோக் சபா ,இந்திரா காந்தி ,ராஜ்யா சபா ,சஞ்சய் காந்தி ,ஜூனியர் ,பெங்கல் சட்டமன்றம் சட்டசபை ,பாராளுமன்றம் கட்டிடம் ,நரேந்திர மோடி ,மைய ப்ராஜெக்ட் ,அரசியலமைப்பு பிரிவு ,நிலை உத்தர் பிரதேஷ் ,அரசியலமைப்பு ஆனால் ,ப்ராஜெக்ட் தொடங்கு ,தெற்கு தமிழ் நாடு ,வடக்கு பஞ்சாப் ,மேற்கு பெங்கல் ,இந்தியா லோக் சபா ,அவள் நிதி ,மேற்கு பெங்கல் சட்டமன்றம் சட்டசபை ,நிலை சட்டசபை ,கழுத்து ,ஆந்திரா பிரதேஷ் ,

© 2025 Vimarsana

comparemela.com © 2020. All Rights Reserved.