Anandabazar
দিল্লি যদি রাজ্যে দল চালায়
সর্বভারতীয় দলগুলিকে ভাবতে হবে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক নিয়ে
মোহিত রায়
২১ জুলাই ২০২১ ০৪:৫৭
বঙ্গনেতা: সুভাষচন্দ্র বসু, হরিপুরা কংগ্রেসে জাতীয় সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর, ১৯৩৮। দলের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের শিকার হবেন তিনি, পরের বছর।
তখনও পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের স্লোগান পাড়ায় শোনা যেত। পাড়ার সভা শুরু হবে। উৎসাহী কংগ্রেসি যুবকেরা স্লোগান দিচ্ছে— রাজীব গাঁধী জিন্দাবাদ। পটলাদা জিন্দাবাদ। হ্যাঁ, দিল্লিতে রাজীব গাঁধী আর পাড়ার পটলাদা, এই দু’জনই গুরুত্বপূর্ণ, মাঝের বাকি নেতাটেতাদের কথা না বললেও চলে। কারণ যা ঠিক হবে দিল্লি থেকেই আর পাড়ায় তার সুফল পটলাদাই বিতরণ করতে পারে। এ-বার পটলাদার কাজ হচ্ছে কোন রাজ্য নেতা দিল্লির কোন নেতাকে ম্যানেজ করছে তার খবর রাখা, পারলে নিজেও একটা চ্যানেল বার করা। এই ছিল একটি সর্বভারতীয় দলের কেন্দ্র রাজ্য সমীকরণের আখ্যান।
সর্বভারতীয় দলগুলির কেন্দ্র ও রাজ্য শাখার আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে কথা এগোবার আগে এ-কথা বলে নেওয়া দরকার যে, ভারতীয় সভ্যতাকে বিনষ্ট করতে দেশের ভিতরের বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির সঙ্গে পশ্চিমি বিশ্বের কিছু শক্তিও সক্রিয়। তাদের সেই চেষ্টাকে প্রতিহত করতে ভারতের কেন্দ্রীয় শাসনক্ষমতায় সর্বভারতীয় দলের প্রাধান্য অত্যন্ত জরুরি। এই পরিপ্রেক্ষিতেই সর্বভারতীয় দলগুলির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নিজেদের রাজ্য শাখার সঙ্গে কী সম্পর্ক গড়ে তুলবে তা গুরুত্বপূর্ণ। এই আলোচনা শুধু পশ্চিমবঙ্গ নিয়েই।
বাংলার কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে দিল্লির কংগ্রেস নেতৃত্বের সংঘাতের এখন শতবর্ষ চলছে। ১৯২২ সালে চৌরিচৌরার ঘটনার পর মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর মর্জিতে কংগ্রেসের দেশ জুড়ে সত্যাগ্রহ আন্দোলন প্রত্যাহার করা বাংলার বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতারা মেনে নিতে পারেননি। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ এবং সুভাষচন্দ্র বসু, দু’জনেই এর বিরোধী ছিলেন এবং কংগ্রেসের বিকল্প স্বরাজ্য দল গঠনের নেতৃত্বে ছিলেন। বিরোধটা খুব কদর্য ভাবে প্রকাশিত হল ১৯৩৯-এর ত্রিপুরী কংগ্রেসে, যখন জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়েও গাঁধীর বিরোধিতায় সুভাষচন্দ্রকে পদত্যাগ করতে হল। কিন্তু এর ঠিক আগে গাঁধীর কংগ্রেস বাংলার প্রতি যে অন্যায় করল, সেই রীতি আজও চলেছে। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে বাংলায় কংগ্রেস ছিল বৃহত্তম দল। ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টির সঙ্গে জোট করে কংগ্রেস সরকার গঠন করলে অখণ্ড বাংলার ইতিহাস হয়তো সম্পূর্ণ অন্য রকমের হত। এই জোটের জন্য কংগ্রেস ও গাঁধীর কাছে জোরালো আবেদন করেছিলেন বাংলার কংগ্রেসের শীর্ষ নেতারা— শরৎচন্দ্র বসু, সুভাষচন্দ্র বসু। কংগ্রেস অসমে আসাম ভ্যালি মুসলিম পার্টির সঙ্গে জোট করে সরকার গঠন করল, কিন্তু কেন্দ্রীয় কংগ্রেস বাংলায় ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টির সঙ্গে জোট করতে অস্বীকার করে বাংলাকে ঠেলে দিল মুসলিম লীগের শাসনে।
Advertisement
Advertisement
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়েও নেহরু কংগ্রেসের একই মাতব্বরি চলল, যা পশ্চিমবঙ্গকে পরিণত করল একটি রুগ্ণ রাজ্যে। ১৯৫০-এর পূর্ব পাকিস্তানে দাঙ্গার সময় দুই বাংলার জনবিনিময় (যা পঞ্জাবে ইতিমধ্যেই হয়ে গিয়েছে) অগ্রাহ্য করে জওহরলাল কুখ্যাত ‘নেহরু লিয়াকত’ চুক্তি স্বাক্ষর করলেন। নেহরুর মন্ত্রিসভায় দু’জন বাঙালি পূর্ণমন্ত্রী ছিলেন— শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও কংগ্রেসের ক্ষিতীশচন্দ্র নিয়োগী, এর বিরোধিতায় দু’জনেই পদত্যাগ করলেন। বাংলার কংগ্রেসের মতামতকে কোনও পাত্তাই দিল না দিল্লি। পূর্ব পাকিস্তান থেকে হিন্দু উদ্বাস্তুর স্রোত অব্যাহত রইল, ভেঙে পড়ল পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি, বাড়ল জনসংখ্যার বোঝা। নেহরু সরকার পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তুদের অস্তিত্বই স্বীকার করল না, পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তুরা উপযুক্ত সাহায্য পেল না, দিকে দিকে রেললাইনের ধারে, স্টেশনের গায়ে, দখলি জমিতে, জলাবাদায় গড়ে উঠতে লাগল দীনদরিদ্র সর্বহারা হিন্দু উদ্বাস্তুদের কলোনি। রাজনীতির উর্বর জমি পেয়ে গেলেন কমিউনিস্টরা। ১৯৬৭’তে পশ্চিমবঙ্গ থেকে কংগ্রেসের বিদায়ের সূচনা করেছিল এই উদ্বাস্তু আন্দোলন। দিল্লির ঔদ্ধত্যে বাংলায় বিধান রায়ের পর আর কোনও বড় কংগ্রেস নেতাই উঠে আসতে পারলেন না। ক্রমশ কংগ্রেস হয়ে দাঁড়াল পাড়ায় পটলাদা, দিল্লিতে নেহরু গাঁধী পরিবার। সাইনবোর্ড ছাড়া জাতীয় কংগ্রেসের কোনও অস্তিত্ব পশ্চিমবঙ্গে আর নেই।
যে অন্য সর্বভারতীয় দলটি পশ্চিমবঙ্গে সেই ১৯৫২-র প্রথম নির্বাচন থেকেই কম হলেও বিধানসভায় দ্বিতীয় স্থানটি দখলে রেখে এসেছিল, তা হল কমিউনিস্ট পার্টি। এর মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে সিপিআইএম প্রধান কমিউনিস্ট দল হিসেবে চৌত্রিশ বছর পশ্চিমবঙ্গ চালিয়েছে। ১৯৭২ পর্যন্ত কমিউনিস্ট বামপন্থী দলগুলির ছিল বিপ্লবের যুগ, সেই বিপ্লবেরও ছিল হরেক রকম চিত্র। কেউ সমাজতান্ত্রিক, কেউ জনগণতান্ত্রিক, কেউ জাতীয় গণতান্ত্রিক, কেউ চিনা মডেল— তা নিয়ে মারামারি খুনোখুনির অন্ত ছিল না। ১৯৭২ থেকে ’৭৭, সরকারি প্রশ্রয়ে গায়ের জোরে বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দখল বামপন্থীদের প্রধান শক্তিকে গৃহবন্দি করে রেখেছিল। তার পর ১৯৭৭ থেকে ২০১১ পশ্চিমবঙ্গে শাসনক্ষমতা দখলে রেখে সিপিআইএম বিপ্লব-টিপ্লব ভুলে একটি সংসদীয় দলে পরিণত হল। এতে অন্যায় কিছু নেই, গণতান্ত্রিক দেশে এতেই মঙ্গল। কিন্তু তার দিল্লির নেতৃত্ব, যাঁদের কেউ কোনও দিন নির্বাচন লড়েন না, মাটির সঙ্গে সম্পর্কহীন, তাঁদের বিপ্লববিলাস থেকেই যায়। তাঁরা রাজ্যে বন্ধ, ধর্মঘট, পুঁজিপতিদের মুণ্ডপাত, কম্পিউটার প্রযুক্তির প্রবেশ বন্ধ, আমেরিকার পরমাণু নীতি চর্চা, বিশ্বব্যাঙ্কের বিরোধিতা— এ-সব বিপ্লবী ব্যাধি রাজ্য নেতৃত্বের উপর চাপিয়ে রাখলেন। ফলে বিপ্লবের মুখোশ পরে একটা নীতিবাগীশ দল পরিচালনা করল একটি অকর্মণ্য সরকার। কমরেড জ্যোতি বসুর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করে দিল্লির নেতৃত্ব তাঁদের ক্ষমতা প্রদর্শন করলেন। ফলে, কিছু পরজীবী বুদ্ধিজীবী ও পরিযায়ী শ্রমিকের উৎপাদন ছাড়া এ রাজ্যে আর কোনও কিছুর বিকাশ ঘটেনি। এক দিন মানুষ তাঁদের পরিত্যাগ করলেন।
পশ্চিমবঙ্গে দক্ষিণপন্থী সর্বভারতীয় দলের সামান্য উপস্থিতি ছিল ১৯৫২-র ও ১৯৫৭-র বিধানসভা নির্বাচনে, জনসঙ্ঘ ও অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভার কিছু আসন প্রাপ্তিতে। ১৯৬২-র পরে তাদের আর প্রায় কোনও চিহ্নই ছিল না। ২০১৪-র পর কেন্দ্রে সর্বভারতীয় দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) শক্তপোক্ত ভাবে আসীন হওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গে ধীরে ধীরে বিজেপি তার শক্তিবৃদ্ধি করেছে। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে ১৮টি আসন জিতে ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যে সরকার গঠনের আশাও বিজেপি করেছিল। তা হয়নি, তবু ৭৭টি আসন জিতে, ৩৮% ভোট পেয়ে এবং বিধানসভায় একমাত্র বিরোধী দল হওয়ার ফলে রাজ্য বিজেপি এবং তার দিল্লির নেতৃত্বের সমীকরণ এখন পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে খুবই প্রাসঙ্গিক।
পশ্চিমবঙ্গের বৌদ্ধিক চর্চায় ও রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থার সার্বিক অনুপস্থিতি নিশ্চয়ই বিজেপি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে এই রাজ্য সম্পর্কে অনেকটাই উদাসীন করে রেখেছিল। গত কয়েক বছরে অবস্থা বদলেছে। ২০১৯-এর লোকসভায় নির্বাচনী সাফল্যে রাজ্য না কেন্দ্র, কার অবদান প্রধান— এই বিতর্ক সংবাদমাধ্যমে স্থান করে নিয়েছে। এর দু’বছরের মধ্যেই ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে ব্যর্থতার দায়ের প্রশ্নেও সেই প্রসঙ্গ ফিরে এসেছে। বিজেপির মনে রাখা প্রয়োজন, যে ভারত একটি কয়েক হাজার বছরের সভ্যতার ভূখণ্ড। এর বিভিন্ন অংশের সমস্যার বৈচিত্র অনেক। তার সমাধানের দায়িত্ব যদি দিল্লি প্রেরিত পর্যবেক্ষকরা নিজেরাই নিয়ে নেন, তবে তা ভ্রান্ত হতে বাধ্য। যেমন, পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম প্রধান সমস্যা তার অস্তিত্বের সমস্যা, যা ভারতের অসম ব্যতীত আর কোনও রাজ্যেরই সমস্যা নয়। এটি বোঝার ও তার জন্য উপযুক্ত রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক পদক্ষেপের চিন্তা দিল্লি থেকে অসম্ভব। কেবল দিল্লির নেতৃত্বের ভরসায় থেকে কংগ্রেস ও বামেরা পশ্চিমবঙ্গ থেকে মুছে গিয়েছে। যে সর্বভারতীয় দলই রাজ্যে তার দিল্লি নেতৃত্বের কলকাতা অফিস হয়ে কাজ করবে, তার ভবিষ্যৎ কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে উজ্জ্বল হবে না।
Advertisement