comparemela.com


পেশাগত কারণে আমাকে এখন শিক্ষক বললে ভূল হবেনা। বিভিন্ন সময়ে নানা বিষয়ে আমি আমার স্টুডেন্টদেরকে বিভিন্ন অভিজ্ঞতার আলোকে শিক্ষা দিতে পছন্দ করি, এবং পারতঃপক্ষে অভিজ্ঞতাগুলো আমার নিজের জীবন থেকেই নিয়ে থাকি। ব্যাপারটা অনেকেরই হয়ত পছন্দ না। অনেকের এটা মনে করাও স্বাভাবিক যে আমি নিজেকে বেশ বড় কিছু হিসেবে জাহির করতে চাচ্ছি কিংবা নিজের ঢোল নিজেই পিটাচ্ছি। কিন্তু এরকমটা করার পিছনে আমার নিজস্ব একটা যুক্তি আছে। যুক্তিটি হচ্ছে, আমিও আমার স্টুডেন্টদের মতোই একজন সাধারন মানুষ। যে প্রশিক্ষণ ওরা পেয়েছে, আমিও তাই পেয়েছি। সুতরাং, আমি যদি কোন কাজ করতে সক্ষম হই, তাহলে সেটা ওদের জন্য মোটেই অসম্ভব কিছুনা। অর্থাৎ, আমি আমার মাধ্যমে ওদের মাঝে “আমিও পারবো” এই আত্মবিশ্বাসটি সৃষ্টি করতে চাই।
আমি একটা ঘটনা আজ এখানে শেয়ার করতে চাচ্ছি। ঘটনাটি ক্যাডেট কলেজের না হলেও এতে পরোক্ষভাবে ক্যাডেট কলেজের সম্পর্ক আছে। আমাদের ব্লগের মাসরুফের সাথে ঐদিন কথা বলতে বলতে ব্যাপারটা চলে এসেছিল। এই লেখাটি লিখতে অবশ্য মাসরুফ ই আমাকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। তবে মজার ব্যাপার হলো, মাসরুফ নিজেও জানেনা ঠিক কি বিষয়ে আমি লিখবো। …ভূমিকা বেশী হয়ে যাচ্ছে। মূল বিষয়ে চলে যাচ্ছি।
কলেজে আমি কোনকালেই কোন খেলাধুলা করিনি। দক্ষিনবঙ্গের ছেলে হিসেবে উত্তরাধিকার সূত্রে সাঁতারে কিছু দখল ছিলো, আর কোন এক ঘটনাসূত্রে হাউসের হয়ে কয়েক বছর হকি খেলতে হয়েছিলো (গোল কীপার হিসেবে)। এই হচ্ছে আমার ৬ বছরের খেলোয়াড় জীবন। য়ার তাই আ্যথলেটিক্স, ভলিবল, ফুটবল, বাস্কেটবল, ক্রিকেট যারা খেলতো, ওরা ছিলো আমার কাছে অনেক উঁচু স্তরের খেলোয়াড়। যেহেতু এই খেলা গুলো আমি পারিনা, তাই নিজের খেলয়াড়নসূলভ অক্ষমতা এবং শারিরীক দূর্বলতাটুকুকে আমি মেনেই নিয়েছিলাম। আমার শক্তিশালী বন্ধুরা যখন খেলার মাঠ কিংবা আ্যথলেটিক্সের ট্র্যাকটিকে বেছে নিয়েছিল, ঠিক তখনই আমি কলেজ অডিটরিয়াম বিশেষ করে স্টেজটিকে আপন করে নিয়েছি।
তো এই শারিরীকভাবে দূর্বল আমিই সিদ্ধান্ত নিলাম আর্মিতে জয়েন করার। আর্মিকে বেছে নেবার কারণগুলোর মধ্যে একটি ছিল early establishment, আর সব চেয়ে বড় যে কারণটা ছিল, তা হচ্ছে, to avoid studies (হায়রে তখন যদি কেউ আমাকে আর্মি’র এই পাহাড় সমান পড়াশুনার কথা বলতো, আমি মনে হয় আর্মিতে জয়েন করার ব্যাপারে দ্বিতীয়বার ভাবতাম)। মনের মাঝে প্রচন্ড ভয় কাজ করছিল-“পারবোতো আমি আমার এই দূর্বল শরীর নিয়ে বিএমএ’র কঠিন প্রশিক্ষণ নিতে?” আমি কতটুকু দূর্বল ছিলাম তার একটা নমুনা দেই। আইএসএসবি’তে অবস্ট্যাকল ক্রসিং এ আমি ৫০ এ মাত্র ৩৯ পেয়েছিলাম যেখানে অনেকেই ৫০ এ ৫০ পাবার পরে আবার বোনাস ও পেয়েছিল।
যাহোক, অবশেষে কিছু না বুঝেই বিএমএ’তে জয়েন করলাম। গেট দিয়ে ঢুকেই সর্ব প্রথম যে জেন্টেলম্যান ক্যাডেটের দেখা পেয়েছিলাম তিনি ছিলেন আমাদেরই কলেজের ফয়েজ ভাই (থুক্কু স্যার)। মুখে কিছু না বললেও পুরা “আরে ফয়েজ ভাই” মার্কা একটা হাসি দিয়েছিলাম মনে হয়। এরপর তিনি আমাকে যে ডোজ দিয়েছিলেন, আমি আমার পুরো বিএমএ লাইফে খুব কমই এরকম ডোজ খেয়েছিলাম। জয়েন করার প্রথম কিছুদিনেই পুরা আউলা হয়ে গেলাম। যা করি তাতেই দোষ। সমান হারে কর্পোরাল, ল্যান্স কর্পোরাল রা চীৎকার করে আর রগড়া দিয়ে আমাদের সিভিল ব্লাডকে মিলিটারী ব্লাডে পরিণত করার চেষ্টায় লিপ্ত। পাশাপাশি হাতে কলমে সব কিছু শিখিয়ে চলছেন…পোশাক পরা থেকে শুরু করে ডাইনিং হল ম্যানার সবকিছু।
ডাইনিং হলে ঢুকতে হলে আমাদের বিশেষ কিছু কায়দা ফলো করতে হতো। প্রতি বেলা খাবারের আগে কিছুক্ষণ নীচে রাস্তায় রগড়া (আমাদের ডাইনিং হল ছিল দ্বোতলায়)। অতঃপর কর্পোরালের মনে দয়া হলে আমাদের নিয়ে যেতেন ডাইনিং হলে। সেখানে আমরা সিঙ্গেল লাইনে দাঁড়াতাম। একজন একজন করে গিয়ে আমাদের জন্য নির্ধারিত দরজার সামনে চেক মেরে জোরে চীৎকার করে “সালাম স্যার” বলতাম। চেক এবং চীৎকার পছন্দ হলে ভিতরে ঢোকার অনুমতি দিতেন কর্পোরাল। এখানেই শেষ নয়। ভিতরে ঢুকে চেয়ার সামনে নিয়ে দাঁড়াতাম। ডাইনিং হলের করিডোরে কর্পোরাল তখন যারা ভিতরে ঢোকার অনুমতি পায়নি তাদেরকে সাইজ করতেন। সাইজ করা শেষ হলে ওদেরকেও ভিতরে ঢুকানো হতো। অবশেষে অর্ডার আসতো, “sit down”। আমরা সবাই সন্তর্পণে চেয়ার টেনে বসতাম যেন পাঁকা মেঝের সাথে কাঠের চেয়ার লেগে কোন শব্দের উৎপত্তি না করে। কিন্তু আমাদের চেষ্টা সবসময়ই বৃথা যেত (বৃথা না হয়ে উপায় কি? পাকা মেঝেতে কাঁঠের চেয়ার টানলে শব্দ তো হবেই)। আর কর্পোরাল যেন এই সময়টার অপেক্ষাতেই থাকতেন। একটু শব্দ শোনার পরই হুংকার, “all of you go out and touch the white wall”। White wall ছিলো আমাদেরকে touch and back দেবার জন্য একটা ল্যান্ড মার্কস। ব্যস, ধুপ ধাপ করে সবাই দৌঁড় শুরু। এই প্রক্রিয়াতে সবাই মোটামুটি জান দিয়ে দিত, কারণ, যে আগে আসবে সে ভিতরে ঢুকে খাওয়া শুরু করবে আর বাকিরা আবার wall touch করতে যাবে। এভাবে একজন একজন করে ভিতরে ঢোকার সুযোগ পাবে। যারা শারিরীকভাবে শক্তিশালী, ভালো খেলোয়াড়, আ্যথলেট টাইপের- ওরা সবসময় আগে চলে আসতো(উল্লেখ্য আমার প্লাটুনে বিভিন্ন ক্যাডেট কলেজের বেশ কিছু বাঘা বাঘা আ্যথলেট ও খেলোয়াড় ছিল)। পাঠকরা নিশ্চয়ই এদের মাঝে আমার অবস্থা কি তা অনুধাবন করতে পারছেন। দুর্বল শরীরের এই জেন্টেলম্যান ক্যাডেটটি এরকম white wall touch and back প্রক্রিয়া শেষ করে যখন ডাইনিং টেবিলে বসে প্লেটটি উল্টিয়ে রাইস নেবার জন্য রাইস ডিসের দিকে হাত বাড়াতো, তখন ই কর্পোরাল আদেশ দিতেন, “time up, close your spoon”। অভুক্ত অবস্থায় বুক ভাঙ্গা কান্না আর অভিমানের দৃষ্টি নিয়ে রাইসের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বের হয়ে আসতাম। রুমে এসে পেট ভরে পানি খেয়ে নিতাম। কখনো কখনো ব্যাটম্যান সোবাহান ভাইকে রুমে পেলে ক্যাফেটেরিয়া (কপালগুনে যদি ঐ সময়ে খোলা থাকতো তাহলে) থেকে ফান্টা, আর বালুসা এনে খেতাম। কিন্তু, এত পরিশ্রমের পর ফান্টা আর বালুসা দিয়ে কিচ্ছু হতোনা। ভাত খাবার জন্য আমার অন্তর কাঁদতো।
এভাবে না খেয়ে কতদিন সহ্য করা যায় বলুনতো? দৌড়ে আগে আসতে পারিনা আর তাই খাওয়ার সময় ও পাইনা। ক্ষুধার জ্বালায় আমি কাতর। ক্ষুধার কারণে আমার দূর্বল শরীর আরো দূর্বল হয়ে পড়লো। রাতে কাঁদতাম ক্ষুধার কারণে। এভাবে চলার ৫/৬ দিন পরে আমার মধ্যে এক নতুন আহসানের জন্ম হলো। মনে মনে ঠিক করলাম, আমাকে ভাত খেতে হবে। মজাদার তরকারী দিয়ে সাজানো থালা ভর্তি ভাত চোখের সামনে কল্পনায় তখন ভেসে উঠতো। ডিসিশান নিয়ে ফেলি, আমাকে ভাত খেতেই হবে…।যেকোন মূল্যের বিনিময়ে…।আমি ক্ষুধার্ত…আমি ভাত খাব…। আজ আমি ভাত খা…বো…ই…।
সেদিন লাঞ্চে নিয়ম অনুযায়ী আমরা আবার কর্পোরালের আওয়াজ পেলাম, “why did you make sound? All of you go outside.” আমরা চেয়ার থেকে উঠে দাড়ালাম। বাইরে বের হচ্ছি। আমার মাথায় তখন একটাই চিন্তা। আমাকে ভাত খেতে হবে…। যেভাবেই হোক…। আমাকে আজ আগে আসতে হবে এবং ভাত খেতে হবে। হঠাৎ শুনলাম, “Go and touch the white wall….”। আমি আর কিছু শুনিনি… আর কিছু মনে নেই… শুধু মনে আছে… “আমাকে ভাত খেতে হবে… আমকে আজ যে করেই হোক ভাত খেতে হবে… আমার অনেক ক্ষুধা… আমি ক্ষুধার জ্বালা সইতে পারছিনা…”। সম্বিত ফিরে পেলাম কর্পোরালের কন্ঠস্বরে, “Ok, Ahsan Habib get inside. Others, go and touch the wall again. I will keep only the first man”। আমি গগন বিদীর্ণ করে “সালাম স্যার” বলেই ঢুকে পড়লাম। চেয়ার টেনে বসে পড়লাম। আমার চোখ চকচক করছে। ভাত খাবার আসন্ন সুখ আমার মুখে পানি নিয়ে এসছে। শরীর ঘামে ভিজে একাকার। টপটপ করে ঘাম ঝরছে। আমার কোন দিকে খেয়াল নেই। প্লেটে ভাত নিয়ে বুভূক্ষের মত গোগ্রাসে গিলতে থাকলাম ঘাম মেশানো সেই ভাত। কতদিন পরে আমি ভাত খাচ্ছি। আনন্দে আমার চোখে পানি এসে গেল…। আমার সেই আনন্দ অশ্রু আমার ঘামের সাথে ার ভাতের সাথে মিশে একাকার। সেদিন আমি অনেক অনেক দিন পরে পেট ভরে ভাত খেলাম।
ভাত খেয়ে আমার মাথা ঠান্ডা হলো। রুমে গিয়ে হঠাত আমার খেয়াল হলো- “আরে… আমি আজ এটা কি করলাম? স্বীকৃত সব বাঘা বাঘা আ্যথলেটদের হারিয়ে দিলাম? দৌঁড়ে ওরা আমার কাছে আজ হেরে গেল? তা কি করে সম্ভব? তবে কি আমি দৌঁড়াতে পারি?”
জীবনে আমি এই প্রথম আবিষ্কার করলাম আমিও দৌঁড়াতে পারি। এরপর থেকে আমি দৌঁড় শুরু করলাম…এখনো আমি দৌঁড়াচ্ছি। আমি এখন দৌঁড় কে ভয় পাইনা। আমার একটা দিনের উপলব্ধি , একটা বিশেষ ঘটনা আমাকে নতুন করে নিজেকে চিনিয়েছে। আমি নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করেছি। আমি আমার সামর্থ্যকে খুঁজে পেয়েছি। জীবনের এতগুলো বছর পরে আমি জানলাম যে আমিও দৌঁড়াতে পারি। ার নিজেকে চিনতে পারার কারণেই আজ আমি এখনো এই বয়সে সদ্য বিএমএ থেকে পাস আউট করে আসা সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট এর সাথে দৌঁড়ে কমপিট করতে প্রস্তুত। মালয়েশিয়া এবং থাইল্যান্ডের প্রশিক্ষণে দৌঁড়িয়ে রেখে এসেছি বাংলাদেশের সাফল্যের ছাপ।
আমার এই ঘটনাটিকে দয়া করে কেউ অন্য দৃষ্টিতে দেখবেননা। এই ব্লগে আমার এটা শেয়ার করার উদ্দশ্য নিজেকে চ্যাম্প হিসেবে জাহির করা না। আমরা অনেকেই আমাদের নিজেদের ভেতরের সামর্থ্য সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত না। হয়তো কোন একটা বিশেষ ঘটনা আমাদের সামনে এসে উপলব্ধি করিয়ে দেয় আমাদের সামর্থ্যের ব্যাপারে। আর এই ঘটনাটিই তখন হয়ে যায় আমাদের জীবনের টার্ণিং পয়েন্ট। জীবন চলার পথে আমাদেরকে সেই সামর্থ্যকে খুঁজে বের করতে হবে। আর একবার যদি আমরা আমাদের সেই সামর্থ্যকে খুঁজে পাই, সফলতা আমাদের কাছে ধরা অবশ্যই দিবে…দিতে বাধ্য। ক্যাডেট কলেজ আমাদের মাঝে অনেক সম্ভাবনা এবং সামর্থ্য নামক সফলতার বীজ বুনে দিয়েছে। আসুন আমরা সবাই নিজের মাঝে সেই বীজটিকে খুঁজে বের করি। আমি জানি, আপনারা পারবেন, কারণ আপনারা ক্যাডেট। ক্যাডেটরা পারেনা এমন কিছু আছে কি?
৫,৪১৩ বার দেখা হয়েছে
প্রকাশিত লেখা বা মন্তব্য সম্পূর্ণভাবেই লেখক/মন্তব্যকারীর নিজস্ব অভিমত। এর জন্য ক্যাডেট কলেজ ব্লগ কর্তৃপক্ষকে কোনভাবেই দায়ী করা চলবেনা।
৬৩ টি মন্তব্য : “টার্ণিং পয়েন্ট”

Related Keywords

Thailand ,Batman Sobhan ,Bagha ,Cadet Collegear Bagha ,Cadet College Us Center ,Cadet College ,College Faiz ,Flight Education ,Training They ,Friends When ,Hey Faiz ,Salam Sir ,Sat May ,Land Marx ,Centeri State ,For Rice ,State Book ,New Ahsan ,தாய்லாந்து ,பாகா ,கேடட் கல்லூரி ,ஒளி கல்வி ,அமர்ந்தார் இருக்கலாம் ,க்கு அரிசி ,நிலை நூல் ,

© 2025 Vimarsana

comparemela.com © 2020. All Rights Reserved.