comparemela.com


আফগানিস্তান: বিশ্ব রাজনীতির পরিত্যক্ত খেলার মাঠ
পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তে নিজেদের পতাকা নিয়ে উল্লাসরত তালেবানরা। মার্কিন বাহিনী আফগানিস্তান থেকে প্রত্যাহার করার কিছু দিনের মধ্যেই তালেবানদের দাপট শুরু হয়েছে। ছবি: রয়টার্স।
27th Jul, 2021
মার্কিন বাহিনী আফগানিস্তান ছাড়ার ঘোষণা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেখানকার গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলো একে একে তালেবানদের কব্জায় চলে যাচ্ছিল। সম্প্রতি তালেবানরা দাপট দেখিয়ে সরকারি বাহিনীর কাছ থেকে অনেকগুলো জেলার নিয়ন্ত্রণ ছিনিয়ে নিয়েছে। এখন আফগানিস্তানের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং গজনি ও ময়দান ওয়ারদাকের মতো মধ্যাঞ্চলীয় প্রদেশগুলো তালেবানদের নিয়ন্ত্রণে বলে বিশ্ব গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে। বিদ্রোহী এ দলটি কুন্দুজ, হেরাত, কান্দাহার ও লস্কর গাহ-র মতো গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোরও কাছে চলে এসেছে। 
মহামারীর মধ্যেও আফগান সংঘাত থামেনি। এ বছরের প্রথম ছয় মাসেই সরকারি বাহিনী ও তালেবান বিদ্রোহীদের লড়াইয়ে দেশটিতে রেকর্ড সংখ্যক বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে। সংঘাতের কারণে এ বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় তিন লাখ আফগান বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। এই ছিল আফগানিস্তান নিয়ে সবশেষ তথ্য। তবে আফগানিস্তানের এ ধরনের সংঘাত এখন আর এ প্রজন্মকে বিস্মিত, বিচলিত বা বাক্রুদ্ধ করে না। 
কেননা ‘আফগানিস্তান’ মানেই কয়েক গত প্রজন্মের কাছে এক যুদ্ধ-বিধ্বস্ত অভিশপ্ত জনপদ। অগুণতি পাহাড়ে ভরা প্রাচীন এ জনপদের নাম নিতেই দৃশ্যপটে ভেসে ওঠে-  জনপ্রতি গড়ে বিশ কেজি করে বোমা ঢালছে মার্কিন বাহিনী, অথবা বস্তাবন্দি কোনো জীবের মতো হেঁটে চলেছে আফগান নারী। সুদীর্ঘকাল থেকেই বহুজাতিক সামরিক জোটের কাছে এ যেন এক বিস্তৃত এবং অনন্য খেলার মাঠ। আয়তনে বাংলাদেশের চেয়ে প্রায় ছয় গুণ বড় আফগানিস্তানকে ঘিরে রয়েছে পাকিস্তান, ইরান, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান এবং তাজিকিস্তান। এর মধ্যে পাকিস্তান ও ইরান সম্পর্কে নানা ধারণা পাঠকের আছে আশা করি। তালিকার পরের তিনটি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত দেশ। উল্লেখ্য, দেশগুলোর মধ্যে ইরান এবং তুর্কমেনিস্তান বিশ্বের অন্যতম তেল সমৃদ্ধ দেশ।
ইতিহাসের পাঠক নিশ্চয়ই ‘ডুরান্ড লাইন’ এর কথা পড়েছেন। এ কৃত্রিম মানচিত্রের মাধ্যমে ব্রিটিশ ভারতকে আফগানিস্তান থেকে আলাদা করা হয়েছিল এবং আফগানিস্তানের বেশ কিছু অংশ ব্রিটিশ ভারতের ভোগে নেওয়া হয়েছিল (এখন যেটি পাকিস্তানের ভাগে)। এ লাইনের বিশেষত্ব হচ্ছে, আরব সাগরে যেতে হলে আফগানিস্তানকে এ লাইন পেরিয়ে ব্রিটিশ ভারতের উপর দিয়ে যেতে হত (দেশ ভাগের পর পাকিস্তানের উপর দিয়ে)। ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অংশ নিতে আফগানদের আবশ্যিকভাবেই এ দেশের মুখাপেক্ষী (তখনকার ভারত আর এখনকার পাকিস্তান) হতে হতো। কঠিনতম বিকল্প ছিল ইরানের বন্দর ব্যবহার করা। যেটির জন্য পাড়ি দিতে হতো বহুদূরের পথ।
ভৌগোলিক এ জটিল অবস্থানকে মাথায় নিয়ে এবার ভূ-রাজনীতির চিত্রটা ভাবুন। ১৯৫১ সালে মোসাদ্দেক ইরানের প্রথম নির্বাচিত সরকার প্রধান হিসেবে ক্ষমতায় এসেই  দেশটির তেলক্ষেত্রগুলোর জাতীয়করণ করেন। ওদিকে ব্রিটিশরা ভারত থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিলেও, বিশ্ব বাণিজ্যে তখনও দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল। মোসাদ্দেকের এ জাতীয়করণে বিপাকে পড়ে বৃহৎ তেল কোম্পানি ব্রিটিশ কর্পোরেশন (এখন যেটিকে বিপি বা ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম নামে চেনেন সবাই)। ইরানের প্রায় আড়াই লাখ বর্গমাইল এলাকা ছিল এ তেল কোম্পানির অধীনে। ১৯৪১ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত ইরান থেকে এ কোম্পানি তেল রপ্তানি করেছে ৬২ দশমিক ৪০ কোটি টন অপরিশোধিত তেল। বিনিময়ে ইরান পেয়েছে ৪২ কোটি ডলার এবং ব্রিটিশ কোম্পানি সব বাদ দিয়ে মুনাফা করেছে ৫০০ কোটি ডলার! (সূত্র: রেভুলশনারি ইসলাম,  সোরুশ ইরফানি)
মোসাদ্দেক সমস্ত তেলক্ষেত্র রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নিলে, থলের বেড়ালের সন্ধান পায় আশেপাশের দেশগুলোও। বাহরাইনেও দাবি উঠে ব্রিটিশ-আমেরিকান কোম্পানিকে হটিয়ে তেলক্ষেত্র জাতীয়করণের, দাবি উঠে মিশরেও। এর মধ্যে মিশরে ক্ষমতায় আসেন আবদুল নাসের এবং সুয়েজ খাল জাতীয়করণ করে ফেলেন। স্বাভাবিকভাবেই ব্রিটিশদের বিশ্ব বাণিজ্য নকশা বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে মরীয়া ব্রিটিশরা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মিলে মাত্র দুই বছরের মাথায় সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মোসাদ্দেককে সরিয়ে ইরানের ক্ষমতায় নিয়ে আসে জেনারেল ফয়জ উল্লাহ জাহেদিকে।
আমরা জানি, আফগানিস্তানের একদিকে ইরানের সাথে এক হাজার কিলোমিটারের সীমান্ত, অন্য দিকে পাকিস্তানের সাথে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কিলোমিটারের সীমান্ত। উল্লেখিত সামরিক অভ্যুত্থান পরবর্তী ইরানের জাহেদি সরকার এবং পাকিস্তানের জিয়া-উল হক সরকার দুটোই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সহায়ক এবং সহযোগী শক্তি হিসেবে ধরা দেয়। ফলে ভূরাজনীতিতে চাপে পড়ে যায় আফগানিস্তান । উল্লেখ্য, আফগানিস্তানের তৃতীয় বৃহত্তম সীমান্ত যোগাযোগ তাজিকিস্তানের সাথে, যেটি তখন সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত দেশ। সোভিয়েতের প্রভাব ছিল ইরাকে এবং আফগানিস্তানে। তখন শোলা, পরচাম এবং খালক- এ তিন নামে তিনটি বামপন্থি গ্রুপ আফগান রাজনীতিতে সক্রিয় ছিল। যার মধ্যে শক্তিশালী পরচাম গ্রুপের হাত ধরে প্রিন্স দাউদ আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আসেন ১৯৭৩ সালে।  দাউদ ক্ষমতায় এসে ভূমি সংস্কার সহ বিভিন্ন ইতিবাচক পদক্ষেপ নেন। তবে নানামুখী আন্তর্জাতিক রাজনীতির খেলায় পরচাম গ্রুপের অনেককেই সরকার থেকে সরিয়ে দেয়। এর পাশাপাশি ইরানের রাজা মোহাম্মদ রেজা শাহ্‌-র  গোয়েন্দা সংস্থা সাভাক (SAVAK) এর মাধ্যমে দাউদ এর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে উঠে শাহ্‌ এর সাথে; যে সম্পর্ক পরে সিআইএ-র দুয়ার পর্যন্ত গড়ায়।
যা হোক, ১৯৭৮ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানের (সউর বিপ্লব/Saur Revolution)  মাধ্যমে দাউদকে হটিয়ে আফগানিস্তানের ক্ষমতায় বসেন অন্য বামপন্থি গ্রুপ খালকের সভাপতি তারাকি। যিনি ক্ষমতায় এসে নিজেকে জাতীয়তাবাদী এবং বিপ্লবী হিসেবে দাবি করেন। ইরান কিংবা পাকিস্তান থেকে দূরত্ব বজায় রাখার কঠিন নীতিতে অগ্রসর হতে থাকেন তারাকি।  যুক্তরাষ্ট্রের তখন মাথায় হাত। ইরানের মাধ্যমে সদ্য দাউদকে বশে এনেছিল মার্কিনিরা, সেটি ভেস্তে যাবার উপক্রম হয়। দ্রুত পরিবর্তিত আফগানিস্তানে নিজেদের ছক বাস্তবায়নে তারাকি সরকারকে নিয়ে পশ্চিমা মাধ্যমে প্রচারণা শুরু করা হয়- এরা নাস্তিক, ধর্মবিরোধী, সোভিয়েত অনুচর। মনে রাখা ভালো, আফগানিস্তানের শিক্ষার হার তখন ১০ শতাংশের মতো এবং মানুষের গড় আয়ু ৪০ বছরের নিচে, স্থাবর জমির অধিকাংশই ছিল মুষ্টিমেয় মানুষের মালিকানাধীন, যারা মূলত রাজনীতি এবং ধর্মীয় দল ও উপদলগুলো নিয়ন্ত্রণ করতো।
কঠোর ভূমি সংস্কার আইন বাস্তবায়নের ফলে সেসব ভূ-স্বামীর স্বার্থে আঘাত আসে এবং উপরোক্ত পশ্চিমা প্রচারণায় দেশিয় এজেন্টের ভূমিকা পালনে নামে এরা, সাথে জোটে ধর্মীয় গ্রুপগুলো।
ঘটনা থেমে থাকেনি। ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইরানে ঘটে যায় খোমেনির ইসলামী বিপ্লব এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন আগ বাড়িয়ে আফগানিস্তানে ঢুকে পড়ে একই বছরের ডিসেম্বরে। সামনে আসে বিপ্লবের আফগান মডেল! এদিকে ভূরাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ আফগান ভূমির নিয়ন্ত্রণ নিতে এবং সোভিয়েতকে তার ‘ভিয়েতনাম’ ফেরত দিয়ে উচিত শিক্ষা দিতে মার্কিনীরা রাজনীতির ছকে পরিবর্তন আনে। মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ায় প্রভাব বজায় রাখতে এবং সোভিয়েতকে পেছনে ঠেলে দিতে যুক্তরাষ্ট্রের দরকার ছিল, হয় ইরানের নিয়ন্ত্রণ অথবা আফগানিস্তানের। ইরানের ইসলামী বিপ্লব সেই ছক বাস্তবায়নে প্রাচীর হয়ে দাঁড়ালেও, আফগানিস্তানে সোভিয়েতের প্রবেশ ‘শাপে বর’ হয়ে আসে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য।
আগের মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের রণকৌশল ছিল সোভিয়েতকে ঠেকিয়ে রাখা, কিন্তু রেগান প্রশাসন এগোয় সোভিয়েতকে পেছনে ঠেলে দেওয়ার কৌশল নিয়ে। কার্টার চেয়েছিলেন শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, অন্য দিকে রেগান চাইলেন পালটা আঘাত করতে। কিন্তু ভিয়েতনামে যেভাবে সরাসরি আঘাত  যুক্তরাষ্ট্র করছিল, সেভাবে নয়। স্থানীয় বা বিশ্ব সোভিয়েতবিরোধীদের জড়ো করে সোভিয়েতকে আফগানিস্তানে আটকে ফেলে শিক্ষা দেওয়ার পরিকল্পনা করে মার্কিন সরকার। সেই পরিকল্পনায় সবচেয়ে শক্তিশালী ও প্রভাবশালী সোভিয়েতবিরোধী শক্তি হিসেবে ইসলামপন্থিদেরই বেছে নেন রেগান প্রশাসন।
এদিকে ‘সউর’ বিপ্লবের পর আফগানিস্তানে জাতীয়তাবাদী শক্তির উত্থানে সব ইসলামপন্থিরা ‘ডুরান্ড লাইনে’র ওপারে পাকিস্তানে আশ্রয় নিতে চাইলে জিয়া-উল হক সরকার তাতে সাহায্যের হাত বাড়ায় নানান সমীকরণে। প্রথমত, আফগানিস্তানে জাতীয়তাবাদী শক্তির উত্থান পাকিস্তানকে শঙ্কিত করে ১৯৭১ এর বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা থেকে। দ্বিতীয়ত, ভূট্টোকে ফাঁসি দেওয়া এবং ৫৪ জন ভারতীয় যুদ্ধবন্দিকে জেনিভা কনভেনশন অনুসারে ফেরত না দিয়ে রেড ক্রস থেকে লুকিয়ে কারাগার থেকে সরিয়ে ভিন্ন ভিন্ন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়াসহ নানা মানবাধিকার ইস্যুতে পাকিস্তান তখন মারাত্মক চাপের মুখে ছিল।  মার্কিনসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সাহায্য কমে গিয়েছিল উল্লেখযোগ্যভাবে। কিন্তু আফগান ইস্যুতে মার্কিন প্রশাসন বহুগুণ উৎসাহ নিয়ে পাকিস্তানে সামরিক এবং অর্থনৈতিক সাহায্য বাড়িয়ে দেয় এ শর্তে যে, আফগান ‘মুজাহিদিন’ দলকে সব ধরনের সাহায্য করতে হবে।
মুজাহিদিনদের প্রশিক্ষণের ঘাঁটি গড়ে উঠে পাকিস্তানে। সারা বিশ্ব থেকে উগ্র ইসলামপন্থিদের জড়ো করা শুরু হয় সেসব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। সৌদি আরব, আলজেরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মিশর থেকে শুধু নয়, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনের মতো উন্নত বিশ্ব থেকেও মুজাহিদিনদের সাথে যোগ দিয়েছিল, সেসব দেশের সংখ্যালঘু মুসলিমরা। পাঠকের মনে থাকবে বাংলাদেশ থেকেও অনেকে সেই প্রশিক্ষণ নিয়ে আফগানিস্তানে যুদ্ধ করতে গিয়েছিল।
জিহাদের জন্য বিশ্ব মুসলিম জনগোষ্ঠীকে প্রলুব্ধ করার মিশনে সবচেয়ে আলোচিত প্যালেস্টাইনি নাগরিক শেখ আজ্জাম, আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামী আইনে ডক্টরেট করে কিং আবদুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় যুক্ত ছিলেন তখন। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ্জামের একজন ছাত্র হচ্ছেন ওসামা বিন লাদেন। লাদেন ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ স্নাতক করেছেন। উদ্দেশ্য ছিল- ধনকুবের বাবার নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের দেখভাল করবেন। পাঠক নিশ্চয়ই জানেন যে, লাদেন পরিবার হার্ভার্ড ও ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচুর অর্থ অনুদান দিয়েছে শিক্ষা ও গবেষণা খাতে। কিন্তু আজ্জামের দীক্ষা লাদেনকে শিক্ষা গবেষণায় অর্থ দেওয়ার চেয়েও জিহাদে মনোযোগী হতে প্রলুব্ধ করতে থাকে। পাকিস্তানি সাংবাদিক রশিদ আহমেদের বক্তব্য অনুসারে, লাদেন প্রথম পেশওয়ারে আসেন ১৯৮০ সালে এবং এরপর থেকে নিয়মিত অর্থ সাহায্য নিয়ে হার্ভার্ড নয়, যাওয়া শুরু করেন আফগানিস্তানে।
এরমধ্যে, লাদেনের ব্যাকগ্রাউন্ড দেখে সিআইএ-র মনোযোগ যায় তার দিকে। ১৯৮৬ সালে সিআইএ-র অর্থায়নে একটি বিশাল প্রকল্প বাস্তবায়নে পরিকল্পিতভাবেই ঠিকাদার হিসেবে নিযুক্ত হন ওসামা বিন লাদেন। প্রকল্প ছিল পাকিস্তানের সীমান্তঘেরা খোস্ত এলাকায় সুড়ঙ্গ তৈরি করা। ওই পাহাড়ি সুড়ঙ্গই মুজাহিদিনদের অস্ত্র রাখার প্রধান ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, ব্যবহৃত হয়েছে যুদ্ধে আহতদের চিকিৎসার কাজে এবং সামরিক প্রশিক্ষণের কাজেও। এ প্রকল্পের সমস্ত অর্থ ঢেলেছে সিআইএ এবং একইসাথে প্রকাশ্যে মুজাহিদিনদের সামরিক কিংবা অর্থনৈতিক সাহায্য জুগিয়ে গিয়েছে। ১৯৮৫ সালে প্রেসিডেন্ট রেগান হোয়াইট হাউজে একদল আফগান যোদ্ধাকে টেলিভিশনে পরিচয় করিয়ে দেন এই বলে যে, নৈতিক মানদণ্ডে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা জনকদের সঙ্গে এই ভদ্রলোকদের কোনও তফাত নেই!
কিন্তু, শেখ আজ্জামের শিষ্য হিসেবে সিআইএ-র ছকে আফগানে লাদেনের প্রবেশ ঘটলেও, আফগান যুদ্ধের শেষ দিকে এসে দুজনের চিন্তায় ফারাক ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠে। লাদেন চেয়েছিলেন এ জিহাদের দাবানল বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে। এমন কি সৌদি আরব বা মিশরেও জিহাদের কথা ভেবেছিলেন লাদেন। কিন্তু আফগান জিহাদের মূল সেনানায়ক আজ্জাম চাননি কোনও মুসলিম দেশে জিহাদ করতে।
১৯৮৯ সালের শেষ দিকে খোস্ত শহরে জিহাদের ভবিষ্যৎ ঠিক করতে একটা বৈঠক হয়। সে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন জামাল আল ফদল নামের সুদানের এক ব্যক্তি। যিনি পরে পূর্ব আফ্রিকার একাধিক মার্কিন দূতাবাসে বোমা বিস্ফোরণের মামলায় আটক হন। আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে আল ফদল জানান, সে বৈঠকেই আফগান সীমান্তের বাইরে জিহাদ চালিয়ে যাওয়ার জন্য একটি নতুন সংগঠন তৈরি করা হয়েছিল- যার নাম ‘আল-কায়দা’। উল্লেখ্য লাদেনের সাথে আজ্জামের দ্বন্দ্বের মাঝেই পেশোয়ারে একটি মসজিদে যাওয়ার পথে গাড়ি বোমা বিস্ফোরণে নিহত হন আজ্জাম। [তথ্য সূত্র: গুড মুসলিম, ব্যাড মুসলিম, মাহমুদ মামদানি)
কোটি কোটি ডলারের সে খেলায় লাখ লাখ জিহাদিতে গড়ে উঠলো মুজাহিদিন বাহিনী, লড়ে গেল অনুপ্রবেশকারী সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে। ভিয়েতনামে মার্কিনিরা নিজের সেনা পাঠিয়ে যে ভুল করেছিল, সেই একই ধরনের ভুল এবার করে বসলো সোভিয়েত ইউনিয়ন। সেনা পাঠিয়ে আটকে গেল আফগানিস্তানে। যুক্তরাষ্ট্র সে ভুলের সুযোগ নিয়েছে পুরোপুরি, কিন্তু নিজে যুক্ত হয়নি সরাসরি।
এর মধ্যে বিশ্ব রাজনীতিতে ‘শীতল যুদ্ধ’ যবনিকার দিকে এগোতে থাকে। সোভিয়েত ইউনিয়নে পেরিস্ত্রৈকা ও গ্লাসনস্ত কর্মসূচির বাস্তবায়ন শুরু হয় এবং ইউনিয়ন ভাঙনের দিকে এগোতে থাকে। সে বাস্তবতায় ১৯৮৮ সালে এক চুক্তির আলোকে আফগানিস্তান থেকে ১৯৮৯ সাল নাগাদ সেনা প্রত্যাহার করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। পরে সোভিয়েতও ভেঙে যায় ১৯৯০ সালের দিকে। আফগানিস্তান চলে যায় মুজাহিদিনদের দখলে। আফগান সভ্যতাকে আরো খানিক পেছনে ঠেসে দিয়ে সারা বিশ্ব থেকে জড়ো হওয়া কথিত জিহাদিরা এরপর ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। বিচ্ছিন্নভাবে বিশ্বের নানান প্রান্তে কথিত জিহাদেরও চেষ্টা করে। এরই মধ্যে মুজাহিদিনের জঠরে সৃষ্ট লাদেনের আল-কায়দা ২০০১ সালে হামলা চালায় টুইন টাওয়ারে। রেগানের আফগানিস্তান রণনীতি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বুমেরাং হয়ে পড়লে, বুশ প্রশাসনও রেগানের কৌশল থেকে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যায়। সরাসরি যুদ্ধে না জড়ানোর কৌশল থেকে সরে এককেন্দ্রিক বিশ্বে আফগানিস্তানে হামলা করতে দুইবার ভাবতে হয়নি যুক্তরাষ্ট্রকে। ‘জিহাদি’দের জড়ো করে সোভিয়েতকে শিক্ষা দেয়ার পালা শেষে, ‘বড্ড বাড় বেড়ে যাওয়া’ আফগানিস্তানকেও ‘উচিত শিক্ষা’ দিয়ে ছেড়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ইত্যবসরে লিবিয়াকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতেও ভাবতে হয়নি যুক্তরাষ্ট্রকে। ভাবতে হয়নি সাদ্দামের ইরাককে ধ্বসিয়ে দিতেও। এতো শত জমজমাট খেলা শেষে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারে চুক্তি করে যুক্তরাষ্ট্র এবং প্রত্যাহার এখন শেষ ধাপে।
ভূ-রাজনীতির কারণে যে আফগানিস্তানের জন্য ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিক থেকে লড়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্র, সেই ভু-রাজনীতির অপরাজিত অধিপতি এখন যুক্তরাষ্ট্রই। অর্থনীতিতেও। সেই সূত্রে আফগানের মূল প্রাকৃতিক সম্পদ তেল এবং গ্যাস নিয়ন্ত্রণ করছে ইনোকল কর্পোরেশন, পাশের দেশ  সাবেক সোভিয়েত-ভুক্ত তাজিকিস্তানের তেল গ্যাসের নিয়ন্ত্রণ ব্রিটিশ কোম্পানি টেথিস পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের হাতে, মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে আছে ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম। ফলে অর্থনৈতিক যে হিসাব থেকে আফগানিস্তানে আধিপত্য জরুরী ছিল সেটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘বিজয়ীর’ অনুকূলে। তাই আফগানিস্তানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কী হচ্ছে সেটি নিয়ে মিছে চিন্তিত হবার বিলাসিতা ততক্ষণ অন্তত যুক্তরাষ্ট্রের নেই, যতক্ষণ না সেটি তার নিজের জন্য হুমকির কারণ হচ্ছে। কিন্তু আফগানি সাধারণ নাগরিকের দেখার পালা, কী তাদের জন্য অপেক্ষা করছে বিশ্ব রাজনীতির পরিত্যক্ত এ খেলার মাঠে!

Related Keywords

Peshawar ,North West Frontier ,Pakistan ,Afghanistan ,United States ,United Kingdom ,Iran ,Algeria ,Vietnam ,Republic Of ,Suez Canal ,As Suways ,Egypt ,Indonesia ,Russia ,Bahrain ,Azhar University ,Al Qahirah ,Bangladesh ,Maidan ,Vardak ,India ,Turkmenistan ,Israel ,Ghazni ,Saudi Arabia ,Americans ,Afghan ,Soviet ,British ,Palestinian ,Rashid Ahmed ,Kingm Reza ,Abdul Nasser ,Union Country ,Available Islamic Revolutione Soviet Union ,Afghan Issue Us Administration ,United Kingdom Company ,John India Convention Price ,I Soviet Union Country ,Sat Soviet Union ,United Kingdom Company Petroleum ,Unione United States ,King Abdulaziz University ,Afghanistana Army ,Us Embassy ,Yale University ,United Kingdom Petroleum ,Universitya Civil ,Company United Kingdom Corporation ,Al Azhar Universitya Islamic ,Afghanistan National ,Soviet Union Country ,United Kingdom India Afghanistan ,United Kingdom India ,Iran Port ,Mosaddeque Iran ,British India ,British World ,Government Both ,Associate Power ,Available Afghanistan ,Prince David Afghanistan ,Iran Kingm Reza Intelligence ,Iran Or Pakistan ,New David ,Agents Introduction ,February Iran ,Available Islamic Revolution ,Soviet Union August ,Afghan Land ,Middle East ,Iran Islamic Revolution ,Rise Pakistan ,Red Cross ,Afghan Issue ,Advanced World ,Afghanistan War ,Jihad For World Muslim ,Featured Palestinian ,Islamic Act ,Laden Education ,Bin Laden ,Available Her ,President White House ,Afghan Jihad ,Muslim Country Jihad ,East Africa ,Good Muslim ,Bad Muslim ,Viet Nam Americans ,Flight Afghanistan ,Soviet Union ,Bin Laden Al Qaeda ,Twin Tower ,Building Strategy ,Afghanistan Assault ,Afghanistan For ,United Kingdom Company Petroleum Limited ,Afghanistan Political ,பெஷாவர் ,வடக்கு மேற்கு எல்லை ,பாக்கிஸ்தான் ,ஒன்றுபட்டது மாநிலங்களில் ,ஒன்றுபட்டது கிஂக்டம் ,இரண் ,அல்ஜீரியா ,வியட்நாம் ,குடியரசு ஆஃப் ,ஸூயெஸ் கால்வாய் ,எகிப்து ,இந்தோனேசியா ,ரஷ்யா ,பஹ்ரைன் ,அஜார் பல்கலைக்கழகம் ,பங்களாதேஷ் ,மைதான் ,வர்தக் ,இந்தியா ,டர்க்மெனிஸ்தான் ,இஸ்ரேல் ,சவுதி அரேபியா ,அமெரிக்கர்கள் ,சோவியத் ,பிரிட்டிஷ் ,ப்யாலெஸ்டிநியந் ,அப்துல் நாசர் ,தொழிற்சங்கம் நாடு ,ஒன்றுபட்டது கிஂக்டம் நிறுவனம் ,கிங் அப்துலஜிஸ் பல்கலைக்கழகம் ,எங்களுக்கு தூதரகம் ,யேல் பல்கலைக்கழகம் ,ஒன்றுபட்டது கிஂக்டம் பெட்ரோலியம் ,சோவியத் தொழிற்சங்கம் நாடு ,ஒன்றுபட்டது கிஂக்டம் இந்தியா ,இரண் போர்த் ,பிரிட்டிஷ் இந்தியா ,பிரிட்டிஷ் உலகம் ,புதியது டேவிட் ,பிப்ரவரி இரண் ,நடுத்தர கிழக்கு ,இரண் இஸ்லாமிய புரட்சி ,சிவப்பு குறுக்கு ,பின் சுமை ,ப்ரெஸிடெஂட் வெள்ளை வீடு ,நல்ல முஸ்லீம் ,மோசமான முஸ்லீம் ,சோவியத் தொழிற்சங்கம் ,இரட்டை கோபுரம் ,கட்டிடம் மூலோபாயம் ,

© 2025 Vimarsana

comparemela.com © 2020. All Rights Reserved.