comparemela.com


Anandabazar
আবারও ধ্বংসের মুখোমুখি
আমেরিকার প্রস্থান মনে করাচ্ছে সোভিয়েট-ত্যক্ত আফগানিস্তানকে
ইন্দ্রনীল বন্দ্যোপাধ্যায়
২৩ জুলাই ২০২১ ০৫:৪৫
আক্রান্ত: তালিবানদের সঙ্গে সংঘাতের মধ্যে আফগান সেনাবাহিনী পরীক্ষা করে দেখছে একটি পুড়ে-যাওয়া গাড়ি, কাবুল, ২০ জুলাই
তেত্রিশ বছর আগে, সোভিয়েটের সাঁজোয়া গাড়ির মাথায় চেপে এক ডজন সাংবাদিকের সঙ্গে আমিও গিয়েছিলাম জালালাবাদ শহর। দিনটা ছিল মে মাসের এক সুন্দর গ্রীষ্মদিবস। আমাদের কনভয় যখন কাবুলে ঢুকল, হর্ষধ্বনি করে উঠলেন সাধারণ মানুষ, কেউ ছুড়লেন ফুল; সাঁজোয়া গাড়িতে সওয়ার সেনারা নিশ্চিন্তমুখে হাসলেন, হাত নাড়লেন। যেন এক ‘ক্যাথারসিস’-এর মুহূর্ত— বিরাট ট্র্যাজেডির শেষ— অন্তত তেমনটাই তখন মনে হচ্ছিল। নয় বছরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর সংঘর্ষে ইতি ঘোষণা করেছেন সোভিয়েট প্রেসিডেন্ট গর্বাচভ, যে যুদ্ধে তত দিনে শতসহস্র আফগান ও সোভিয়েটের প্রাণ গিয়েছে। সেই সেনা প্রত্যাহার ছিল এমনই এক ধীর, দীর্ঘ প্রক্রিয়া যে, শেষ সোভিয়েট বাহিনীর আফগানিস্তান ছাড়তে হল পরের বছরের ফেব্রুয়ারি। সুশৃঙ্খল ভাবেই ঘটেছিল সেই অপমানজনক প্রত্যাহার।
তখনও কাবুল তার পুরনো চেহারায়। উদারমনস্ক রাজা মহম্মদ জ়াহির শাহের তেত্রিশ বছরের শাসনে সেই শহরে তখনও রাস্তার দু’ধারে গাছের সারি, সুদৃশ্য ইমারত, স্কার্ট-পরিহিত সুন্দরী মেয়েরা। বাজারে মেলে চুরি করা বা ফেলে দেওয়া সোভিয়েট জিনিসপত্র, জামাকাপড়। সেই শেষ বার দেখেছিলাম, কাবুলের চিত্তাকর্ষক রূপ।
এ দিকে সোভিয়েটের পরাজয়কে নিজেদের জয় হিসেবেই দেখেছিলেন পাকিস্তানের সেনাকর্তারা। মুজাহিদিনকে তাঁরা ইসলামি ছকে সাজিয়ে ফেললেন, শুধুমাত্র যে আফগান নেতারা এই ‘লাইন’ মানতে ইচ্ছুক, তাঁদেরই বড় পদে বসানো হল। মহম্মদ নাজিবুল্লার নেতৃত্বাধীন কাবুলের কমিউনিস্ট জমানার নিয়ন্ত্রণে আফগান সেনার বিরুদ্ধে নামানো হল— আমেরিকান সামরিক অস্ত্রশস্ত্রে আপাদমস্তক সজ্জিত, এবং পাক সামরিক গোয়েন্দা-তথ্যে বলীয়ান এই মুজাহিদিন বাহিনীকে। ফল হল বিধ্বংসী। আফগানরা নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি করে শহর-গঞ্জ গুঁড়িয়ে দিল। ১৯৯২ সালে নাজিবুল্লার পদত্যাগের পরেও লড়াই চলতেই থাকল, এ বার মুজাহিদিনদের নিজেদের মধ্যেই। বোমায়-বোমায় প্রায় ধ্বংস হয় কাবুল। শহরটার দিকে তাকানোই যায় না।
Advertisement
Advertisement
১৯৯৫ সালে সে দেশের দখল নিল পাকিস্তানি সেনার তৈরি আর এক উগ্রপন্থী ইসলামি আফগান শক্তি— তালিবান। দেশ জুড়ে কায়েম হল শ্মশানের শান্তি। তালিবানরা শহরে ঢোকার কয়েক ঘণ্টা আগে কাবুল ছাড়ল ভারতের গোটা কূটনৈতিক দল। অতি দ্রুত আল-কায়দা ও অন্য ভারতবিরোধী শক্তি-সহ ইসলামি জঙ্গিদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হল সেই দেশ।
২০০১-এর শেষে কাবুল থেকে তালিবানদের হটিয়ে দিল আমেরিকান বাহিনী। তার কয়েক বছর পর আমি সেখানে গিয়েছিলাম এক বার। সে শহর তখন চূড়ান্ত বিশৃঙ্খল। প্রস্তরযুগের আদিম মানুষদের মতো তালিবানরা তত দিনে গোটা কাবুলকেই যেন শৌচাগার বানিয়ে ফেলেছে। পাক সেনার কাছে কাবুল তখন সেনাছাউনি আর আঁস্তাকুড়ের শামিল। সবাই মিলে সেখানে চালাচ্ছে লুটপাট, পচন ধরাচ্ছে পরতে পরতে। তালিবানদের আসল রাজধানী তখন, কাবুল নয়— দক্ষিণের শহর কন্দহর।
আমেরিকান ও ন্যাটো বাহিনীর হাতে যখন কাবুল আবার খানিক নিরাপদ, সেই সময়ে আমি আবারও কয়েক বার গেলাম। দেখলাম, শহরটা যেন ধীরে ধীরে সেরে উঠেছে, বেড়েও উঠেছে। গ্রাম থেকে অনেক আফগান সেখানে পৌঁছেছেন চাকরি আর নিরাপত্তার খোঁজে। আবারও যেন জ্বলেছে একটা আশার আলো। গ্রীষ্মকালে আবার ফলনে ভরে উঠেছে কাবুল ও আশপাশের অঞ্চলের বাগানগুলো, রাস্তার দু’ধারে আবার দেখা গিয়েছে গাছের সারি, বাজার আবার ভরে উঠেছে জনতার কলরোলে।
শহরের প্রাণকেন্দ্রে বিশাল ভারতীয় দূতাবাসটিও কর্মমুখর হয়ে উঠেছে। সে দেশের পুনর্গঠনে তখন কোটি কোটি ডলার ঢেলে দিয়েছে ভারত সরকার, ভারতে পড়তে আসার জন্য বৃত্তি দেওয়া হয়েছে কয়েক হাজার আফগান ছাত্রছাত্রীকে, এবং আরও অগণিত আফগান মানুষ নিয়মিত আসছেন চিকিৎসার জন্য। পাকিস্তানের সেনাকর্তাদের কাছে অসহ্য ঠেকতে শুরু করে এ সব। তাঁদের গোপন শপথ: আফগানিস্তানের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য থেকে মোটেই বিচ্যুত হওয়া যাবে না। শেষ পর্যন্ত, পরিস্থিতি পরিবর্তনের পথও তাঁরা বার করে ফেললেন।
সাম্প্রতিক খবরাখবর জেনে খারাপ লাগছে। খবর বলছে, গত সপ্তাহে রাতের অন্ধকারে চোরের মতো সে দেশ ছেড়েছে আমেরিকান ও ন্যাটো বাহিনী। সকাল হতেই স্থানীয় মানুষ বিস্মিত হয়ে দেখেছেন, আফগানিস্তানের মাটিতে আমেরিকার বৃহত্তম সেনাঘাঁটি বাগরাম এয়ারবেস দ্বারমুক্ত, রক্ষিহীন। আফগান সেনারা পৌঁছনোর আগেই সেখানে পৌঁছে গিয়েছে লুটেরা-রা। এই লজ্জাজনক পশ্চাদপসরণের মধ্যে কয়েক দিন যেতে না যেতেই দেশের নানা প্রান্ত থেকে এল তালিবানদের প্রবল শক্তিবৃদ্ধির খবর। একটি নামী পত্রিকার মন্তব্য, “আমেরিকার দীর্ঘতম যুদ্ধ শেষ হল এক নিদারুণ পরাজয় দিয়ে। তালিবানরা এখন দেশের বাকি অংশ দখল করার ডাক দিয়েছে— আফগানদের সামনে আবারও অনেক রক্তক্ষয়ের দিন।” তেত্রিশ বছর আগের মে মাসের সকালটা মনে পড়ল। কত পার্থক্য দুই সেনা প্রত্যাহারের ঘটনার মধ্যে। প্রথম ক্ষেত্রে কত আশা তৈরি হয়েছিল (সে আশা যতই ভুল হোক না কেন), আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে? কেবলই হতাশা।
এ বারও নিজেদের জয়ী বলে মনে করছেন পাক সেনাকর্তারা। আর সবচেয়ে বড় পরাজিত হিসেবে তাঁরা দেখছেন ভারতকে; সে কথা বলেওছেন পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান, যিনি প্রকৃতপক্ষে সেনাবাহিনীরই মুখপাত্র বললে ভুল হয় না। ভারতের উদ্দেশে সরাসরি হুমকি দিয়েছেন তাঁর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ রশিদ। ‘আফগানিস্তানের মাটিতে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ চালানো’ এবং ‘গত ৪০ বছর ধরে পাকিস্তান বিষয়ে বিশ্বের কাছে মিথ্যে খবর প্রচার করা’-র জন্য দিল্লিকে দায়ী করেছেন তিনি। রশিদের দাবি, আফগানিস্তানে ‘নাকাল’ হয়েছে ভারত— এখন সেখান থেকে কর্মীদের সরিয়ে নেওয়া ছাড়া তার আর পথ নেই। স্বভাবতই, কন্দহর থেকে কূটনৈতিক কর্মী-দল সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্তও নিতে হয়েছে ভারতকে। তালিবান যদি কাবুল দখল করে, তবে পাকিস্তান সেখানে কখনওই ভারতের প্রতীকী উপস্থিতিটুকু ছাড়া কিছুর অনুমতি দেবে না।
আফগানিস্তানে আমেরিকার ভয়াবহ পরাজয়ের পর এই পুনরুজ্জীবিত পাকিস্তান এখন ভারতের কাছে বিরাট বিপদ। স্পষ্টবাদী পাক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘোষণা: “কোনও বিশ্বশক্তির পক্ষেই পাকিস্তানকে অগ্রাহ্য করা সম্ভব নয়...।” তালিবান প্রসারপর্ব শেষ হওয়ার আগেই আফগানিস্তানের উপর তালিবানের পূর্ণ ক্ষমতা স্বীকার করুক পৃথিবীর সমস্ত দেশ, এটাই এখন পাকিস্তান চায়। পাকিস্তানের এত আত্মপ্রত্যয় কোথা থেকে আসছে, সে হিসেব পরিষ্কার। পাক বাহিনী এবং আফগানিস্তানে পাকিস্তানের প্রক্সি-বাহিনীর কাছে পর্যুদস্ত আমেরিকাকে তো ইসলামাবাদের সঙ্গেই দর-কষাকষি করতে হয়েছে। পাক সেনাপ্রধান বাজওয়া জানিয়েছেন, আমেরিকাকে তাঁর দেশে বিমানঘাঁটি বানানোর অনুমতি দেওয়া হয়নি। এও বলেন যে, আফগানিস্তানে কার্যকলাপ চালানোর জন্য ঘাঁটি বানাতে কোনও দেশকেই পাকিস্তানের মাটি ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না।
এর চেয়ে স্পষ্ট দেওয়াল-লিখন আর কী-ই বা হতে পারে? আফগানিস্তানের পুরনো ঘটনাক্রম স্মৃতিপথে উঁকি মারে। আরও এক শক্তির প্রস্থান ঘটল, আরও এক প্রস্থ ভয়াবহ সংঘাতের অপেক্ষা। আরও এক বার কি ধ্বংসের পথে কাবুল?
Advertisement

Related Keywords

Afghanistan ,United States ,Delhi ,India ,Kabul ,Kabol ,Pakistan ,Islamabad ,America ,Afghan ,American ,Sheikh Rashid ,Imran Khan ,Neil Pakistan ,Islamic Afghan Power ,Kabul India ,Indian Islamic ,Street And ,For Occupation ,Pakistan Prime Minister Imran Khan ,His Minister Sheikh Rashid ,For Delhi ,Afghanistan United States ,Pakistan Minister ,May Earth ,Afghanistan Pakistan ,Americai Islamabad ,America His Country ,Run For ,Country Pakistan ,ஒன்றுபட்டது மாநிலங்களில் ,டெல்ஹி ,இந்தியா ,காபூல் ,பாக்கிஸ்தான் ,இஸ்லாமாபாத் ,அமெரிக்கா ,அமெரிக்கன் ,ஷேக் ரஷித் ,இம்ரான் காந் ,காபூல் இந்தியா ,இந்தியன் இஸ்லாமிய ,தெரு மற்றும் ,பாக்கிஸ்தான் ப்ரைம் அமைச்சர் இம்ரான் காந் ,க்கு டெல்ஹி ,பாக்கிஸ்தான் அமைச்சர் ,இருக்கலாம் பூமி ,ஓடு க்கு ,நாடு பாக்கிஸ்தான் ,

© 2024 Vimarsana

comparemela.com © 2020. All Rights Reserved.