কক্সবাজারের পেকুয়ার রাজাখালীতে অষ্টম শ্রেণিপড়ুয়া মাদরাসা শিক্ষার্থীকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের পর মেয়েটির আত্মহননের ঘটনায় তোলপাড় চলছে। ধর্ষণের অপমানে বিষপানে আত্মহননের প্ররোচনার অভিযোগ এনে তিন বখাটের বিরুদ্ধে মামলা করতে থানায় দেওয়া এজাহার ফিরিয়ে দেওয়ার ঘটনাটি তদন্ত করছেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। একইসাথে সেই রাতে আসলে কী কী ঘটনা ঘটেছিল, তার সবিস্তারে তথ্যও উদঘাটনে নেমেছে পুলিশ।
এরই অংশ হিসেবে গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে সরজমিন ঘটনাস্থল পরিদর্শন, পরিবারের সদস্য এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে ঘটনার বর্ণনা শোনেন কক্সবাজার জেলা পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলাম।
পরিদর্শনকালে শিক্ষার্থীর বাবা, মা, ভাই, স্বজন এবং প্রত্যক্ষদর্শী বেশ কয়েকজন ব্যক্তি ঘটনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আদ্যোপান্ত তুলে ধরেন জেলা পুলিশের মুখপাত্রের কাছে। এ সময় এই পাশবিক নির্যাতন এবং আত্মহননের প্ররোচনাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়াসহ নতুন করে গণধর্ষণের মামলা নিতে পুলিশকে অনুরোধ জানান।
এ সময় জেলা পুলিশের মুখপাত্র সবার বক্তব্য মনোযোগ সহকারে শোনেন এবং তাদেরকে আশ্বস্ত করে বলেন, পুলিশ আপনাদেরকে সকল ধরনের সহায়তা করতে সর্বদা প্রস্তুত রয়েছে। এ নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা করার কারণ নেই। এ জন্যই আমি আপনাদের কাছে ছুটে এসেছি।
এদিকে সরজমিন ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, চাঞ্চল্যকর এই ঘটনার তদন্তকালে পরিবারের সদস্য, প্রত্যক্ষদর্শীসহ স্থানীয়দের দেওয়া বক্তব্য অনুযায়ী ওই শিক্ষার্থীকে গণধর্ষণ পরবর্তী বিষপানে আত্মহননের প্ররোচনা দেওয়ার বিষয়টি আবারও ফুটে উঠেছে।
তদন্তকালে জেলা পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলামের সাথে ছিলেন পুলিশের চকরিয়া-পেকুয়া সার্কেলের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার মো. তফিকুল আলম ও পেকুয়া থানার ওসি মো. সাইফুর রহমান মজুমদার।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে জেলা পুলিশের মুখপাত্র মো. রফিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা মোতাবেক আজ ঘটনাস্থল পরিদর্শন, পরিবার সদস্য এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য নেওয়া হয়েছে। তদন্তকালে যেসব বিষয় আমি পেয়েছি, তা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিতভাবে প্রেরণ করা হবে। এর পর পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে সার্বিক বিষয়ে।
নতুন করে ধর্ষণের কোন মামলা নেওয়া হবে কী-না এমন প্রশ্নে মুখপাত্র বলেন, ঘটনা যা-ই ঘটেছে এর পরিপ্রেক্ষিতে আইন সঠিক নিয়মেই চলবে। সংঘটিত হয়ে যাওয়া কোনো ঘটনা লুকানোর সুযোগ পুলিশের কাছে নেই। অতএব যেকোনো সময় ধর্ষণের মামলা নেওয়া হবে এবং পুলিশ আরও সবিস্তারে তদন্তকাজ শুরু করেছে।
ঘটনার পর মামলা করতে গেলে থানায় পুলিশ কর্মকর্তার দুর্ব্যবহার করার বিষয়ে মুখপাত্র আরও বলেন, জনগণকে সেবা দেওয়ার জন্যই পুলিশ সর্বদা তৎপর রয়েছে। এর পরও থানায় যদি কোনো ভুক্তভোগীর সাথে খারাপ আচরণ করা হয় এবং তদন্তে প্রমাণিত হয় তাহলে যথাযথ ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হবে সেই পুলিশ কর্মকর্তার প্রতি।
পুলিশের করা সুরতহাল প্রতিবেদনেও ছিল ধর্ষণের আলামত
চাঞ্চল্যকর এই ঘটনার পর পেকুয়া থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. নাজমুল হোসেন যান শিক্ষার্থীর বাড়িতে। এ সময় পরিবারের নারী সদস্যদের উপস্থিতিতে নারী কনস্টেবল মৌসুমিকে নিয়ে সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন তিনি। তার (এসআই) স্বাক্ষরিত সেই সুরতহাল প্রতিবেদনেও লেখা রয়েছে ওই ছাত্রীর স্পর্শকাতর স্থানে রক্ত দৃশ্যমান।
জেলা পুলিশের মুখপাত্রের তদন্তকালে সেই সুরতহাল প্রতিবেদনে আত্মহননকারী শিক্ষার্থীর স্পর্শকাতর স্থানে রক্ত দৃশ্যমান থাকার বিষয়টি তুলে ধরে পাশের বাড়ির মাবিয়া বেগম নামের এক নারী বলেন, গণধর্ষণের কারণে তার স্পর্শকাতর স্থান দিয়ে প্রচুর রক্তক্ষরণও হয়। এতে পরনের কাপড়-চোপড় রক্তাক্ত হয়ে যাওয়ায় তা খুলে ধুয়ে ফেলা হয়।
উল্লেখ্য, গত শুক্রবার হাজিপাড়ার নিজ বাড়ি থেকে রাজাখালী বহুমুখী বেশারাতুল উলুম ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীকে তুলে নিয়ে মিয়াপাড়া নুরুন নাহার চৌধুরাণী জামে মসজিদ ও কবরস্থানের পুকুরের টং ঘরে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করে স্থানীয় মৃত বাদশার ছেলে আলমগীর, নুরুল হকের ছেলে রবিউল আলম ও চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার ছনুয়া এলাকার মকসুদ আহমদের ছেলে আবুল কাশেম। সেই ঘটনার পর অপমান সইতে না পেরে শিক্ষার্থী কীটনাশক পান করে আত্মহত্যা করে। পুলিশকে জানানো হলেও ধর্ষণের অভিযোগ আমলে না নিয়ে শুধু বিষপানে আত্মহত্যা করেছে মর্মে অপমৃত্যু মামলা রুজু করতে বাধ্য করার অভিযোগ আনেন শিক্ষার্থীর বাবা। এই অবস্থায় ধর্ষক বখাটেরা অনেকটা উল্লাসে মেতে ওঠে। পরবর্তীতে তারা আত্মগোপনে চলে যায়। এদিকে চাঞ্চল্যকর এই ঘটনায় জড়িত বখাটে-ধর্ষকদের ধরতে মাঠে তৎপর রয়েছে পুলিশের পাশাপাশি র্যাবেরও একটি চৌকষ দল। তারা গত দুইদিন ধরে বিভিন্নস্থানে অভিযান শুরু করেছে সংঘবদ্ধ ধর্ষকদের ধরতে।
এই ব্যাপারে চকরিয়া-পেকুয়া সার্কেলের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার মো. তফিকুল আলম গতকাল সন্ধ্যায় কালের কণ্ঠকে বলেন, চাঞ্চল্যকর এই ধর্ষণের ঘটনায় যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই থানায় মামলা নেওয়া হবে। এজন্য পরিবারের পক্ষ থেকে নতুন করে এজাহার জমা নিতে জেলা পুলিশ সুপার মহোদয় নির্দেশনা দিয়েছেন।
এই রকম আরো খবর